Mary Kom | টাকা-সুযোগ সুবিধার অভাব, সব কিছুকে টেক্কা দিয়ে ছ'বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন! জানুন 'ম্যাগনিফিসেন্ট' মেরি কমের অজানা কাহিনী!
বক্সিংয়ের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন স্কুল। একাধিক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ছ'বারের বক্সিং বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মণিপুরের মেয়ে মেরি কম।
ছোটবেলার থেকেই বক্সিং, খেলাধুলো ছিল সব। যার ফলে ক্লাস সেভেনে ছেড়ে দেন পড়াশোনাও। ইনি, নারীশক্তির অনুপ্রেরণা ছ'বারের বক্সিং বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মেরি কম (Mary Kom)। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে ভারতের মুখ যে মহিলা খেলোয়াড়রা উজ্জ্বল করেছেন তার মধ্যে অন্যতম তিনি। মেরি কম একমাত্র মহিলা বক্সার যিনি পাঁচ বারের বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়ন এবং ছয়টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেই পদক জিতেছেন। ২৪সে নভেম্বর ৪১ বছর পূর্ণ করলেন এই ভারতীয় বক্সার (Indian Boxers)। জেনে নিন মেরি কমের সম্পর্কে অজানা তথ্য।
শৈশব ও শিক্ষা :
মেরি কম ১৯৮২ সালের ২৪ শে নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন উত্তর ভারতের গ্রামীণ মণিপুরের চুরচাঁদপুর জেলার মৈরাং লামখাই, কঙ্গাথী গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে। তাঁর পিতা মাংতে টোনপা কম পেশায় ছিলেন কৃষক ও প্রাক্তন রেসলার। মা মাংতে আখম কম। উল্লেখ্য, মেরি কমের আসল নাম কিন্তু মাংতে চুংনেইজাং মেরি কম। তিন ভাই বোন আর বাবা-মাকে নিয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল মোট পাঁচ জন । বড় মেয়ে হওয়ার সুবাদে চাষবাসের কাজ এবং বাড়ির কাজের অনেক দায়-দায়িত্ব পালন করতে হতো তাকে। এদিকে ছোটবেলার থেকেই বক্সিং, খেলাধুলোর প্রতি আগ্রহ তার। পড়াশোনায় কখনওই আগ্রহী ছিলেন না মেরি। বক্সিংই ছিল ধ্যানজ্ঞান। তখন সেন্ট জ়েভিয়ার্স স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন মেরি। আচমকাই পড়াশোনা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। যদিও তারপর ফের পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। প্রাইভেটে তিনি পড়াশোনা চালিয়েছিলেন। ফাইনাল পরীক্ষাও দেন প্রাইভেটে। পরে প্রাইভেটেই চুড়াচাদপুর কলেজ থেকে তিনি স্নাতক হন।
বক্সিংয়ের মেরি :
ছোট থেকেই দৌড়ানো, ভলিবল খেলা, ফুটবল খেলা এগুলি খুবই পছন্দের ছিল মণিপুরের মেরির। পরে অবশ্য ১৯৯৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমস-এর স্বর্ণ পদকজয়ী ডিঙ্কো সিং-কে (Dinko Singh) দেখে সে খুবই অনুপ্রাণিত হন তিনি এবং বক্সিংয়ের প্রতি তাঁর আরও আগ্রহ বাড়ে। তবে মেয়ের বক্সিংয়ের প্রতি ভালোবাসা-টান দেখে খুব বেশি খুশি হন না মা-বাবা। কারণ বক্সিংকে সাধারণত 'পুরুষদের' খেলা হিসেবেই ধরা হতো। কিন্তু বক্সিং-এর নেশা মেরির মধ্যে এমন ভাবেই চেপে বসে যে সে বাবা-মাকে লুকিয়ে ইম্ফলে বক্সিং শিক্ষক কে. কসানা মেইতেই (K. Kosana Meitei)-র কাছে বক্সিং শিখতে থাকে। প্রায় দীর্ঘ ২ বছর সে এভাবেই লুকিয়ে বক্সিং শিখতে থাকে। এরপর ধীরে ধীরে বক্সিংয়ে পটু হতে শুরু করেন মেরি। তখন সাফল্যের কথা জানতে পারেন মেরি কমের মা-বাবা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বক্সিংয়ে আরও পারদর্শী হয়ে ওঠেন মেরি কম। সঙ্গে আসতে থাকে পর পর সাফল্য। নিজের খেলাকে আরও উন্নত কী করা যায় নিজের মধ্যে তারই অনুসন্ধান করতে লাগে মেরি। ফলে পরবর্তীকালে মণিপুরের রাজ্য বক্সিং কোচ এম. নর্জিত সিংহ (M. Narjit Singh)-এর কাছ থেকে সে বক্সিং শেখে।
বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মেরি কম :
মেরি কম মাত্র ১৮বছর বয়সে, ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড অ্যামেচার বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে (World Amateur Boxing Championships USA) রৌপ্য পদক অর্জন করেছিলেন। তিনিই হলেন প্রথম মহিলা ভারতীয় বক্সার (Indian Boxers) যিনি ২০১২ সালে এআইবিএ (AIBA) চ্যাম্পিয়নশিপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করার পর ২০১২ সালে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন। মেরি কম এআইবিএ (AIBA) ওয়ার্ল্ড উইমেন’স র্যাঙ্কিং ফ্লাইওয়েট ক্যাটাগরিতে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। উল্লেখ্য, বক্সিং-এ তাঁর দুর্দান্ত অবদানের কারণে, আন্তর্জাতিক অ্যামেচার বক্সিং অ্যাসোশিয়েশন (International Amateur Boxing Association ) তাঁর নাম রেখেছিল ‘ম্যাগনিফিকেন্ট মেরি’ (Magnificent Mary)। ২০১৮ সালের ২৪ সে নভেম্বর, নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ১০ তম এআইবিএ মহিলা ওয়ার্ল্ড বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে তিনি ৬ টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ সোনা জয়ী বিশ্বের প্রথম মহিলার শিরোপা অর্জন করেন।
এছাড়া টুর্নামেন্টের ২০১৯ সংস্করণের আগে মেরি কম বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সাতটি পদক জয় করেন। ২০০১ সালে ৪৮ কেজি বিভাগে তাঁর প্রথম পদক ছিল রৌপ্য। ২০০২ সংস্করণে তিনি স্বর্ণ পদক অর্জন করেন। ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে মেরি কম আবারও স্বর্ণপদক অর্জন করেন এবং তারপরে ২০০৮, ২০১০ এবং ২০১৮ সালে তাঁর তালিকায় আরও পদক যোগ হয়। তাঁর অষ্টম বিশ্ব পদকটি অর্জন করে মেরি কম টুর্নামেন্টে এবং আয়ারল্যান্ডের সাতটি পদক প্রাপ্ত কিউবার ফেলিক্স সাভনকে ছাড়িয়ে যান।
বৈবাহিক জীবন :
মেরি কমকে তাঁর সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে বড় ভূমিকা পালন করেন মেরি কমের স্বামী (Mary Kom Husband)।২০০০ সালে বেঙ্গালুরু ট্রেনে ভ্রমণের সময় লাগেজ চুরি যায় কারুন ওংখোলার (Karung Onkholer) নামক এক যুবকের। সেই সূত্রেই তার মেরি কমের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়। এরপর পঞ্জাবের জাতীয় গেমসে যাওয়ার পথেও নয়াদিল্লিতে মেরি ওংখোলার সঙ্গে আবার দেখা করেন। ওংখোলার ছিলেন উত্তর-পূর্ব ছাত্র সংস্থার সভাপতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ তাদের সম্পর্ক ঘন হতে শুরু করে। এরপর ২০০৫ সালে দুজনের বিয়ে হয়। বর্তমানে দুটি যমজ পুত্রসন্তান, একটি পুত্র ও কন্যা সন্তনের অভিভাবক তারা। উল্লেখ্য, কন্যা সন্তান দত্তক নেন মেরি কম ও মেরি কমের স্বামী (Mary Kom Husband)। মাতৃত্ব কখনোই মেরির কেরিয়ারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। প্রথমবার তিনি যমজ সন্তানের মা হওয়ার পরেও বক্সিং চালিয়ে গিয়েছিলেন।
পদক অর্জন ও সম্মাননা :
মেরি কমের পুরস্কার (Mary Kom Awards) তালিকার মধ্যে রয়েছে অর্জুন পুরস্কার (Arjuna Award) এর মতো আরও একাধিক পুরস্কার। তিনিই ভারতবর্ষের প্রথম অপেশাদার ক্রীড়াবিদ যিনি পদ্মভূষণ উপাধি পান। ২০১৩ সালে তিনি পদ্মভূষণ পান। এছাড়া ২০১৩ সালে পদ্মবিভূষণ, ২০০৯ সালে মেজর ধ্যানচাঁদ খেলরত্ন অ্যাওয়ার্ড, ২০০৬ সালে পদ্মশ্রী এবং ২০০৩ সালে অর্জুন পুরস্কার (Arjuna Award) লাভ করেন। এছাড়াও ইন্টারন্যাশনাল বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন (এআইবিএ) মেরি কমকে ”আশাপ্রদ বক্সিং ক্যারিয়ার” এর জন্য প্রথম এআইবিএ কিংবদন্তি পুরষ্কার প্রদান করে পাশাপাশি এআইবিএ মেরি কমকে ২০১৬ এআইবিএ উইমেনস ওয়ার্ল্ড বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসাবে ঘোষণা করে। পিপল অফ দ্য ইয়ার- লিমকা বুক অফ রেকর্ডস, ২০০৭; ‘ম্যাগনিফিকেন্ট মেরি’, এআইবিএ ২০০৮; মহিলাদের বক্সিংয়ের জন্য আন্তর্জাতিক বক্সিং সমিতির রাষ্ট্রদূত ২০০৯ ; ২০১০ সালের ক্রীড়াবিদ, সাহারা স্পোর্টস অ্যাওয়ার্ড ছাড়াও আরও অন্যান্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন মেরি কম।
মেরি কমের পুরস্কার (Mary Kom Awards) এর তালিকা যত বড় তার থেকেও বড় তাঁর অর্জন করে জেতা পদক সংখ্যা। তিনি পৃথিবীর প্রথম মহিলা বক্সার যিনি ৮ টি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপস (World Championship)-এর পদক জয় করেন। শুধু মহিলাদের মধ্যে নয় পুরুষদের মধ্যেও ৮ বার ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের পদক কারুর ঝুলিতে এখনো পর্যন্ত আসেনি। ৮টি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের পদকের মধ্যে ৬ টি সোনা, ১ টি রুপো এবং ১ টি ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। কেরিয়ারে প্রচুর পদক জিতলেও, বিভিন্ন সম্মান ও স্বীকৃতি পেলেও মেরি নিজে খুব গর্ব অনুভব করেন রানির ব্যাটন হাতে তুলতে পেরেছিলেন বলে। ২০১০ সালে দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসের সময় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কুইন্স ব্যাটন বহন করেছিলেন মেরি।
মেরি কম শুধু নিজের সাফল্যে দেশকে একের পর এক গর্বের মুহূর্ত উপহার দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি ব্রতী হয়েছেন দেশকে আরও বক্সার উপহার দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়েও। সেই কারণে ২০০৭ সালে নিজ রাজ্যে, মণিপুরে একটি অ্যাকাডেমি খুলেছেন মেরি কম। সেখানে উদীয়মান, প্রতিভাবান বক্সারদের নিজে প্রশিক্ষণ দেন মেরি। উন্নত পরিকাঠামো যুক্ত এই অ্যাকাডেমিতে অগুনতি গরীব মেয়েদের নিখরচায় প্রশিক্ষণ দেন মেরি। দারিদ্র যাতে কারও স্বপ্নপূরণের পথে বাধা না হয়ে দাঁড়ায় সেটা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর মেরি কম। এছাড়াও পশুপ্রেমী মেরি কম।পশুরক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রচারমূলক অভিযানে সামনের সারিতে থাকেন মেরি। বিনোদন বা অন্য কোনও কারণে পশুদের ক্ষতি হতে দেখলেই গর্জে ওঠেন। উল্লেখ্য, নারীশক্তির অনুপ্রেরণা মেরি কমের জীবন সংগ্রাম , কঠোর লড়াইকে শিল্পজগতও সম্মান দিতে ২০১৪ সালে মুক্তি পায় তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি বায়োপিক ছবি ‘মেরি কম’। যাতে মেরি কমের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়া (Priyanka Chopra)। জীবনে বহু না পাওয়ার জন্য সাধারণত অনেকেই অর্থনৈতিক অবস্থা, সুযোগ-সুবিধার অভাব কিংবা বিবাহিত জীবন বা সন্তান প্রতিপালনকে বাধা হিসেবে ধরে থাকেন। কিন্তু শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তি এবং পরিশ্রম করার ক্ষমতাকে হাতিয়ার করে যে কোনো মানুষই যে তাঁর 'অসম্ভব' স্বপ্নকে সম্ভব করতে পারে তার বড় উদাহরণ মণিপুরের মেয়ে 'ম্যাগনিফিসেন্ট' মেরি কম।
- Related topics -
- খেলাধুলা
- বক্সিং
- মেরি কম
- জীবন ও জীবনী
- ভারত
- মনিপুর
- বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন
- কমনওয়েলথ গেমস
- পদ্মশ্রী
- পদ্মভূষণ