গুরুপূর্ণিমা দিনটির মাহাত্ম্য, Importance of Guru Purnima এক্সপ্লেইনেড in Bengali
"গুরুব্রহ্মা গুরুবিষ্ণু গুরুদেবো মহেশ্বর গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ" অর্থাৎ গুরু ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, যারা আমাদের পরম ব্রহ্মজ্ঞান দান করেছেন সেই গুরুর উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন।
গুরু পূর্ণিমা কেন পালন করা হয়, Why do we celebrate Guru Purnima ?
Read also :
গুরু পূর্ণিমা মূলত গুরু কে ভিত্তি করে প্রচলিত একটি বিশেষ উৎসব যা সনাতন ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুসারে বহুকাল ধরে পালিত হয়ে আসছে। এই উৎসবে শিবের রূপে জগতের সমস্ত আচার্য দের গুরু হিসেবে পূজা করা হয়। ভগবান শিব থেকেই সমগ্র সনাতন ধর্মশাস্ত্র প্রকট হয়েছে বলে কথিত আছে, তাই শিব আদিগুরু হিসেবে জগৎ বিখ্যাত। 'গুরু' শব্দটি 'গু' এবং 'রু' এই দুই সংস্কৃত শব্দের সম্মেলনে গঠিত; 'গু' শব্দটির অর্থ "অন্ধকার" / "অজ্ঞতা" এবং 'রু' শব্দের অর্থ " অন্ধকারকে দূরীভূত করা "। অর্থ্যাৎ, 'গুরু' শব্দ দ্বারা এমন একজন ব্যক্তিকে নির্দেশ করা হয় যিনি অন্ধকার দূর করেন।
ধর্মীয় বিশ্বাস, Religious faith
হিন্দু সনাতন শাস্ত্র অনুসারে, গুরূপূর্নিমার তিথি তে পরমেশ্বর মহাদেব দক্ষিণামূর্তিরূপ ধারণ করেন এবং ব্রহ্মার চার মানসপুত্র কে বেদের গুহ্য পরম জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। পরমেশ্বরের দক্ষিণামূর্তি সকলের আদি গুরু বলে বিশ্বাস করা হয়, তাই এই তিথিটি মহাদেবের প্রতি সমর্পিত।
পুরাণ অনুসারে আদিযোগী শিব এই বিশেষ তিথিতে আদিগুরুতে রূপান্তরিত হয়ে তাঁর শিষ্যগণ, সপ্তর্ষির সাতজন ঋষি – অত্রি, বশিষ্ঠ, পুলহ, অঙ্গীরা, পুলস্থ্য, মরীচি এবং ক্রতু -কে মহাজ্ঞান প্রদান করেন বলে বিশ্বাস করা হয়। তাই এই তিথি গুরুপূর্ণিমা নামে পরিচিত।
এছাড়াও এই বিশেষ দিনে মুনি পরাশর ও মাতা সত্যবতীর ঘরে 'মহাভারত' রচয়িতা মহর্ষি বেদব্যাস জন্মগ্রহণ করেন; ফলে দিনটি 'ব্যাস পূর্ণিমা' বলেও পরিচিত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মীয় জনগন এই বিশেষ দিনটিকে মহা সাড়ম্বরের সাথে উদযাপন করে থাকেন। বৌদ্ধ ধর্মেও গুরুপূর্ণিমার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মতানুসারে, বোধিজ্ঞান লাভের পর গুরুপূর্ণিমার এই বিশেষ তিথিতেই গৌতম বুদ্ধ সারনাথে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে প্রথম উপদেশ দিয়েছিলেন।
বেদব্যাস, Vedvyas
কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বা বেদব্যাস বা সংক্ষেপে ব্যাস পৌরাণিক কালের একজন ঋষি ছিলেন। ব্যাস মুনি ঋষি বশিষ্ঠের প্রপৌত্র, শক্তি মুনীর পৌত্র, পরাশর মুনীর পুত্র তথা শুকদেবের পিতা। ইনি হিন্দুধর্মীয় প্রাথমিক প্রত্যাদিষ্ট হিন্দুশাস্ত্র বলে স্বীকৃত বেদের ব্যবহারিক-বিন্যাসকারী হিসেবে পরিচিত। মহর্ষি ব্যাস পৌরাণিক মহাকাব্য মহাভারত ছাড়াও বেদান্তদর্শনের সংকলক, সম্পাদক এবং সমন্বায়ক এক জ্ঞানান্বেষী ঋষি।
মহর্ষি বেদব্যাসের জন্ম, Birth of rishi Vedvyas
পৌরাণিক কালে যমুনা নদীতে খেয়া নৌকার মধ্যে পরাশর মুনি সত্যবতীর সাথে মিলিত হন, অতঃপর সত্যবতী গর্ভবতী হন এবং যমুনার একটি দ্বীপে বেদব্যাসের জন্ম হয়। তিনি গুরু পূর্ণিমার বিশেষ দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যমুনার দ্বীপে জন্ম হয়েছিল বলে তাঁর নাম রাখা হয় দ্বৈপায়ন। ব্যাসের গায়ের রং কালো ছিল বলে, পুরো নাম কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন রাখা হয়েছিল।
জন্মের পরই তিনি মা সত্যবতীর অনুমতি নিয়ে তপস্যার জন্য যাত্রা করেন। তাঁর তপস্যার স্থানটি ছিল বদরিকাশ্রম যার কারণে তিনি বাদরায়ণ নামেও পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন তপস্যাবলে মহর্ষিত্ব লাভ করেন এবং বেদবিন্যাস করে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন। উক্ত কারণে তিনি বেদব্যাস বা 'ব্যাস' নামে পরিচিতি লাভ করেন।
পুরাণ রচনা, Composition of Purana
Read also :
মহর্ষি বেদব্যাসের চারটি বেদেরই সম্পূর্ণ জ্ঞান ছিল। তিনি বেদ রচনা করেননি তবে বেদকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং চারটি ভাগে বিভক্ত করেছেন, সেগুলি হল: ঋক্, সাম, যজু ও অথর্ব। বহু শতাব্দী ধরে ভারতীয় ধর্মীয় ইতিহাসে গুরু পুজোর প্রথা চলে আসছে। গুরু রূপে পূজিত হন যে মহান তাপস তিনিই হলেন মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। মহর্ষি বেদব্যাস ভাগবত , মহাভারত ইত্যাদি হিন্দু ধর্মীয় যত পুরাণ আছে সবই তিনি রচনা করেন ।
"যথাতে সংযোগ হয় বিয়োগ অবশ্য।
শরীর অনিত্য জান মরণ অবশ্য।।"
হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ মহাভারতের এরূপ হাজারও শ্লোকের রচনা করেন ব্যাসদেব। মহাভারত থেকে জানা যায় যে তিনি "মহাভারত" লিপিবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ভগবান ব্রহ্মার নিকট একজন লিপিকার নিয়োগের পরামর্শ গ্রহণ করতে যান, ব্রহ্মা তখন গণেশকে নিয়োগ করার কথা বলেন। গণেশ লিপিকার হতে সম্মতি দেওয়ার পূর্বে একটি শর্ত রেখেছিলেন যে, লিপিবদ্ধ করার কাজে ব্যাসদেব ক্ষণমাত্রও বাক্য পাঠ থামাবেন না। ব্যাস তাতে রাজি হন কিন্তু সাথে অপর একটি শর্ত জুড়ে দিয়ে বলেন যে , গণেশ যেন কোনো বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ না বুঝে লিপিবদ্ধ ন করে। অতঃপর এই শর্তে গণেশ রাজি হলে মহাভারত লেখার কাজ শুরু হয়।
মহর্ষি ব্যাসদেব তাঁর শ্লোকগুলো রচনাকালের সময় কিছু জটিল শ্লোকও রচনা করতেন। যেগুলির অর্থ বুঝে লিখতে গিয়ে গণেশ যে সময় ব্যয় করতেন, সেই সময়ের মধ্যেই ব্যাস মুনি আরও অনেক শ্লোক তৈরি করে ফেলতেন।
গুরুপূর্ণিমা পুজোর নিয়ম, How to worship Guru Purnima
গুরুপূর্ণিমা পুজোর আলাদা করে বিশেষ কোনও নিয়ম নেই। তবে ভগবানকে ভোগ হিসেবে নানা নিরামিষ খাবার, যেমন লুচি ও সুজি, খিচুড়ি , তরকারি, ভাজা, পায়েস, ক্ষীর, তথা নানা প্রকার মিষ্টি ইত্যাদি দেওয়া যায়। এছাড়াও গঙ্গাজল, দই, মধু এবং ড্রাই ফ্রুট সহযোগে চরণামৃত তৈরি করে অর্পণ করা হয়ে থাকে। পূর্ণিমা তিথি চলাকালীন সময়ে নিরামিষ খাবার খেয়ে শুদ্ধ থাকা উচিত বলে বিশ্বাস করা হয়। অনেকে এই বিশেষ দিনে বাড়িতে সত্যনারায়ণের সিন্নিও দেন। যে-কোনও শুভ কাজ করার ক্ষেত্রে এই দিনটিকে অত্যন্ত শুভ দিন বলে মনে করা হয়।
Read also :
উপসংহার, conclusion
বাংলা আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতেই গুরুপূর্ণিমা পালন করা হয়। এই দিনে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়, কারণ গুরুদের বচনকে পাথেয় করার মাধ্যমেই এগিয়ে চলা সকলের জীবনের মূল লক্ষ্য। তাই ধর্মীয় শাস্ত্রেও দিনটির মাহাত্ম্য অনেক বেশি।
- Related topics -
- দেশ
- গুরুপূর্ণিমা
- গুরুত্ব