শহর কলকাতা

Howrah Bridge History | ৮১ বছর পেরিয়েছে 'গ্রান্ড ওল্ড লেডি অফ কলকাতা গেটওয়ে'! জানেন তিন দশকের পরিকল্পনা শেষে কীভাবে তৈরী হলো হাওড়া সেতু?

Howrah Bridge History | ৮১ বছর পেরিয়েছে 'গ্রান্ড ওল্ড লেডি অফ কলকাতা গেটওয়ে'! জানেন তিন দশকের পরিকল্পনা শেষে কীভাবে তৈরী হলো হাওড়া সেতু?
Key Highlights

প্রথমে তৈরী হয়েছিল ভাসমান সেতু। পরে ১৯৩৭ সালে শুরু হয় হাওড়া ব্রিজ নির্মাণ কাজ। অবশেষে ১৯৪৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয় কলকাতা-হাওড়া ব্রিজ।

দীর্ঘ ৮১ বছর ধরে তিলোত্তমার অন্যতম গর্ব ও ঐতিহ্য হিসেবে হুগলি নদীর ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এই সেতু। ২০২৪ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি, ছিল তার জন্মদিন। এই সেতু হাওড়া ব্রিজ (Howrah Bridge)! ১৯৪৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি নদী পেরিয়ে যাতায়াতের সুবিধার্থে নির্মাণ হয়েছিল কলকাতা-হাওড়া ব্রিজ (Kolkata Howrah Bridge)। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হলুদ ট্যাক্সি, হাতে টানা রিক্সার সঙ্গে হাওড়া সেতুও কলকাতার এক ল্যান্ডমার্ক। বর্তমানে যে হাওড়া সেতু বিরাজমান তা নির্মাণ করতে ছয় বছর সময় লাগলেও, সেতু নির্মাণের পরিকল্পর্ণা কিন্তু চলে তিন দশক ধরে।

হাওড়া সেতুর ইতিহাস । Howrah Bridge History :

ভারত ও এশিয়ার প্রথম নোবেল জয়ী বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামকরণ করা হয় এই ব্রিজ। হুগলি নদীর উপর নির্মিত হাওড়া কলকাতা দুই শহরকে যুক্ত করেছে হাওড়া ব্রিজ (Howrah Bridge) বা রবীন্দ্র সেতু। প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ অসংখ্য যানবাহন যাতায়াত করে এই ব্রিজ হয়ে। শুধু হাওড়া বা কলকাতা নয়, সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যও অন্যতম এই ব্রিজ। এই সেতু সাক্ষী আট দশকের  একাধিক নানান ঘটনার। যার ফলে এই সেতুকেই আবার বলা হয় 'গ্রান্ড ওল্ড লেডি অফ কলকাতা গেটওয়ে' (Grand Old Lady of Calcutta Gateway)। হাওড়া সেতুর দৈর্ঘ্য (Howrah Bridge Length)৭০৫ মিটার অর্থাৎ ২৩১৩ ফুট এবং প্রস্থ ২১ মিটারেরও বেশি এবং উচ্চতা প্রায় ৮২ মিটার। এই ব্রিজ নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় ছ’বছর। ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৩৬ সালে এবং নির্মাণ শেষ হয় ১৯৪২ সালে। তবে সেতুটি নির্মাণ করার জন্য লেগেছিলো তিন দশকের পরিকল্পনা।

পন্টুন ব্রিজ :

বর্তমান হাওড়া ব্রিজের আগে সেখানে অবস্থিত ছিল পন্টুন ব্রিজ বা ভাসমান সেতু। আসলে প্রথম একটা সেতু বানানোর কথা ব্রিটিশ প্রশাসন ভেবেছিলো ১৮৫৫-৫৬ সালে। মূলত নদীর দুপাড়ে বাড়তে থাকা কারবারের জন্যই সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর জন্য রীতিমতো তৈরী হয়েছিল কমিটি। তবে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বছর চারেক পর ১৮৫৯-৬০ সালে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে সময়েও সরকারের প্রকল্প প্রস্তাবিত হয়েও ঠান্ডা ঘরে যেত। এরপর দীর্ঘ আট বছর পর ঠিক হয়, এ বার সেতু একটা বানাতেই হবে। তখন ত়ৎকালীন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর সিদ্ধান্ত নেন, সেতু নির্মাণের যাবতীয় দায়িত্ব সরাসরি সরকারের হাতে থাকবে না। ফলে ১৮৭১ সালে তৈরি হয় একটি ট্রাস্ট। সেই ট্রাস্টের অধীনেই হাওড়ার প্রথম ভাসমান সেতু নির্মাণের ভার দেওয়া হয় স্যর লেসলিকে। তিনি বিলেতে ফিরে গিয়ে সেতুর ডেক এবং ভাসমান সমতল ‘নৌকা’ বানানোর কাজ শুরু করেন। জাহাজে সেই মাল পৌঁছল কলকাতা বন্দরে। তার পরে একে একে সমতল নৌকার উপর পর পর ডেকগুলি জুড়ে তৈরি হয় প্রথম হাওড়া ব্রিজ। বা  ভাসমান সেতু। লম্বায় ১৫২৮ ফুট, ৪৮ ফুট চওড়া। দু’পাশে সাত ফুটের ফুটপাত। জাহাজ-স্টিমার চলাচলের জন্য সেতুর মাঝখানে ২০০ ফুট খুলে দেওয়া যেত। স্টিমার এলেই সেতু বন্ধ। তবে কিছু সময় পেরোতেই এই সেতু নিয়েই সৃষ্টি হয় নয়া সমস্যা।

ভাসমান সেতুর সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল জাহাজ-স্টিমার যাতায়াতের ব্যবস্থা। জাহাজ গেলেই গাড়ি চলাচলের জন্য সেতু বন্ধ হয়ে যেত। যানজটও বাড়তো। কারণ, দিনের বেলাতেই কেবলমাত্র সেতু খোলা যেত। এই ব্যবস্থা চলে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত। তার পর রাতেও জাহাজের জন্য সেতু খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। তাতে আগে যেখানে দিনে ২৪ বার সেতু খুলতে হত, তা কমে দিনে মাত্র চার বার সেতু খুলতে হতো। বন্দরের নথি বলছে, ১৯০৭-০৮ সালে হাওড়া ব্রিজের মাঝখান দিয়ে ৩০২০টি জাহাজ-স্টিমার-লঞ্চ যাতায়াত করেছিল। তবে রাতে জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা হলেও যানজটের সমাধান হচ্ছিল না। ফলে সে সময় থেকেই হাওড়াতে একটি নতুন সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকে ব্রিটিশ প্রশাসন।

দ্য নিউ হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট 

ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্বেই নতুন একটি সেতুর কথা ভাবা হচ্ছিল। তার অন্যতম কারণ ছিল হাওড়া ব্রিজের উপর গরুর গাড়ির দাপট। ফলে বন্দর কমিশনার বৈঠক ডেকে নতুন সেতুর প্রস্তাবনা করেন। তৈরি হয় একটি কমিটি। বন্দরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার জন স্কট, পূর্ব রেলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আর এস হাইট এবং কলকাতা পুরসভার চিফ ইঞ্জিনিয়ার ম্যাককেব ওই কমিটির সদস্য হন। ভাবনা শুরু হয়, ভাসমান সেতুর বদলে একটি ক্যান্টিলিভার সেতু নির্মাণের। তবে ক্যান্টিলিভার সেতু বানানোর পরিকল্পনা পছন্দ হয়নি লেসলির। নতুন প্রযুক্তি নিয়ে ভারতে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাননি তিনি। ফলে লেসলি সাহেব নতুন একটি ভাসমান সেতুর পক্ষেই মত দিয়েছিলেন। একই মতামত ছিল পোর্ট কমিশনারেরও।  নতুন সেতু কোথায় হবে, কোন প্রযুক্তিতে হবে, সেতু নির্মাণের সময় যান চলাচলের সমস্যা মিটবে কী ভাবে ইত্যাদি বিষয়ে শুরু হয় ইঞ্জিনিয়ারদের তর্ক-বিতর্ক। প্রায় ২০-২২ বছর চর্চার পরও যখন ইঞ্জিনিয়াররা সহমত হতে পারেননি, তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কমিটি তৈরি করা হয়। তার পরে সেই কমিটির সিদ্ধান্ত অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়ে নতুন সেতুর পরিকল্পনা-নকশা তৈরি হয়। হাওড়া সেতুর ইতিহাস (Howrah Bridge History) বলছে, প্রাথমিক কমিটি গঠনের পর ১৯১১ সালে নতুন হাওড়া সেতু নির্মাণের নকশা চাওয়া হয়। পরের বছর সারা বিশ্ব থেকে ৯টি সংস্থা ১৮টি নকশা জমা দেয়। কিন্তু সব ক’টি নকশাই ছিল বাসকুল মডেলে। অর্থাৎ সেতুর মাঝ বরাবর খোলা রাখার ব্যবস্থা রেখেছিল সব সংস্থাই। এর মধ্যে এসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঘাত। ফলে ব্রিটিশরা নতুন কোনও পরিকাঠামো প্রকল্প থেকে সরে আসে। শেষমেশ ১৯২১ সালে জমা হওয়া নকশা ফেলে ফের তর্ক শুরু হয়। সামনে আসে পোর্ট কমিশনার আর রেলওয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ভিন্ন মতের কথাও।

অবশেষে ব্রিটিশ প্রশাসন একটি মধ্যপন্থা বার করেন। ১৯২১ সালে স্যর রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে  মাথায় রেখে একটি কমিটি গড়ে। তিনি তখন মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানির অন্যতম মালিক। কমিটির সদস্য তৎকালীন কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান ক্লিমেন্ট হিন্ডলে, চিফ ইঞ্জিনিয়ার জে ম্যাগ্লাসান। কমিটি তৎকালীন বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার বেসিল মট-এর পরামর্শ গ্রহণ করে। স্যর বেসিলই প্রথম ‘সিঙ্গল স্প্যান আর্চড ব্রিজ’-এর প্রস্তাব করেন। ১৯২২ সালে আর এন মুখার্জি কমিটি চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে। তাতে যাবতীয় বিতর্ক সরিয়ে ক্যান্টিলিভার সেতু নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। ঠিক হয়, এমন প্রযুক্তি হবে যাতে সেতুর নীচ দিয়ে অনায়াসে জাহাজ-স্টিমার যাতায়াত করতে পারবে। এরপর ১৯২৬-এ পাস হয় ‘দ্য নিউ হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট’ (The New Howrah Bridge Act)।

হাওড়া ব্রিজ নির্মাণ :

১৯৩০ সালে ১৫ই  মার্চ বাংলার গভর্নর বৈঠক ডেকে সেতু নির্মাণের জন্য এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ১৯৩৭-এ ব্রিজ তৈরি শুরু হয়, কাজ শেষ হয় ১৯৪২-এর অগস্টে। উল্লেখ্য, হাওড়া সেতুর দৈর্ঘ্য (Howrah Bridge Length)৭০৫ মিটার অর্থাৎ ২৩১৩ ফুট এবং প্রস্থ ২১ মিটারেরও বেশি এবং উচ্চতা প্রায় ৮২ মিটার।  হাওড়া ব্রিজ তৈরিতে ২৬ হাজার ৫০০ টন ইস্পাত লেগেছিল। তার মধ্যে ২৩ হাজার ৫০০ টন সরবরাহ করেছিল টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি লিমিটেড (Tata Iron and Steel Company Limited )। হাওড়া ব্রিজই সম্ভবত প্রথম ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প, যার কাঁচামালের সবটাই ভারত থেকেই নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু টাটা স্টিল চাইলেই ব্রিটিশরা তাদের বরাত দেয়নি। বলা হয়েছিল ‘ক্রেডেনশিয়াল’ দেখাতে। টাটা কর্তৃপক্ষ জানায়, মেঘনা নদীর উপর ভৈরববাজারে একটি রেলসেতুর জন্য তারা ৩৪০০ টন ইস্পাত সরবরাহ করেছে।ব্রিটিশরা এই ক্রেডেনশিয়ালে খুশি হয়েছিল। পরবর্তী কালে টাটারা ইস্পাত সরবরাহ করেন। আর ‘বিবিজে’ হাওড়া ব্রিজের ফ্যাব্রিকেশন-এর কাজ করে।

অবশেষে  ব্রিটিশ আমলে পর পর দু’টি সেতু নির্মাণের পর ১৯৪৩-এর ৩রা ফ্রেব্রুয়ারিতে তা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বলা বাহুল্য, জনসাধারণের জন্য এই সেতু খুলে দেওয়ার আগে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে, এই সেতু থেকে কিছুটা দূরেই একটি জাপানি বোমা পড়েছিল। আর একটু হলেই কলকাতা হারিয়ে ফেলত তার আইকনিক ল্যান্ডমার্ককে। তবে তা হয়নি। উল্লেখ্য, ১৯৪৭-এ হাওড়া ব্রিজে গাড়ি চলত দিনে ৩৪ হাজার। এখন চলে সোয়া লাখের থেকেও বেশি। পথচারী পাঁচ লাখ। সম্ভবত দেশের প্রথম সেতু কলকাতা-হাওড়া ব্রিজ (Kolkata Howrah Bridge), যার নির্মাণ রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি আইনসিদ্ধ।