Jagadhatri Puja 2023 | জগদ্ধাত্রী পূজার নবমীতে ভক্তদের ভিড় চন্দননগর-কৃষ্ণনগরে! দেখুন বিখ্যাত পুজোর ঝলক! জানুন কেন দেবীর পদতলে থাকে হস্তিমুন্ড?
জগদ্ধাত্রী পূজা ২০২৩ তে মায়ের আরাধনায় মেতে গোটা বঙ্গ। জগদ্ধাত্রী পূজাতে চন্দননগর-কৃষ্ণনগরে ভিড় জমিয়েছেন ভক্তরা। জানুন চন্দননগর-কৃষ্ণনগর-ভদ্রেশ্বরের বিখ্যাত কিছু পুজো সম্পর্কে।
দুর্গাপুজো, দীপাবলি, ভাইফোঁটা কাটিয়ে এবার বঙ্গবাসী মেতে উঠেছে জগদ্ধাত্রী (Jagadhatri)র আরাধনায়। আলোতে সেজে উঠেছে চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গ (Chandannagar West Bengal)। কৃষ্ণনগর, চন্দননগর-সহ জগদ্ধাত্রী পূজা (Jagadhatri Puja) ধুমধাম করে পালন হচ্ছে গোটা পশ্চিমবঙ্গেই। আজ, ২১সে নভেম্বর, মঙ্গলবার জগদ্ধাত্রী পূজা ২০২৩ (Jagadhatri Puja 2023) এর নবমী তিথি। বলা হয়, জগদ্ধাত্রী পুজোর অষ্টমী এবং নবমী তিথিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই নবমী তিথিতেই বেশির ভাগ বারোয়ারি পুজো গুলি হয়। দুর্গোৎসবের মতো চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গ (Chandannagar West Bengal)এ জগদ্ধাত্রী মায়ের পুজো করা হয় চারদিন ধরে। জগদ্ধাত্রী (Jagadhatri) দেবী হলেন আদ্যাশক্তি মহামায়ার আর এক রূপ। মানা হয়, জগদ্ধাত্রী ঠাকুর (Jagadhatri Thakur) গোটা জগত্কে ধারণ করে রেখেছেন। সিংহের উপর আসীন দেবীর পদতলে রয়েছে একটি হাতির কাটা মুণ্ড। অনেকেই ভেবে থাকেন দেবী জগদ্ধাত্রী কোনও অসুরকে বধ করেছেন। আসলে মায়ের এই রূপ বধ করছিলেন দেবতাদের অহংকার-রূপী অসুরকে।
পুরাণ অনুসারে, মহিষাসুর বধের পর অত্যন্ত উল্লসিত ও গর্বিত হয়ে ওঠেন দেবতারা। তাঁরা ভাবেন যে দেবী দুর্গা তো তাঁদেরই সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ। ফলে মহিষাসুর বধের কৃতিত্ব তাঁদেরই। দেবতাদের ওই গর্ব দেখে পরমেশ্বরী দেবী তাঁদের শক্তি পরীক্ষা করতে একটি তৃণখণ্ড তাঁদের দিকে ছুড়ে দেন। ইন্দ্রের বজ্র দিয়ে সেই তৃণটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়, তবে অগ্নিদেব সেই তৃণ পোড়াতে পারেন না। বায়ুদেবও সেটি উড়িয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হন এবং বরুণ দেবের শক্তি সেই তৃণকে জলস্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না। তখন তাঁদের দুরবস্থা দেখে দেবতাদের সামনে আবির্ভূতা হন পরমাসুন্দরী সালঙ্কারা চতুর্ভূজা দেবী জগদ্ধাত্রী। তিনিই দেবতাদের বুঝিয়ে দেন যে আসলে দেবীই এই জগতের ধারিণী শক্তি। এর থেকেই জগদ্ধাত্রী ঠাকুর (Jagadhatri Thakur) এর মূর্তিতে থাকা হাতিকে দেবতাদের মনের অহংকারকে তুলে ধরে। দেবতাদের মনের অহংকার জগদ্ধাত্রী দেবী বধ করেছিলেন বলে তাঁর মূর্তির নীচে হাতির কাটা মুণ্ডু দেখা যায়। আবার মনে করা হয়, সংস্কৃতে হাতির অপর নাম করী, সেই কারণে করীন্দ্রাসুর নামে অসুরকে বধ করেন বলে জগদ্ধাত্রীর অপর নাম করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী। এই দেবী সিংহের পিঠে আসীন, নানা অলঙ্কারে ভূষিতা ও নাগরূপ যজ্ঞোপবীতধারিণী। দেবীর দুই বাম হাতে শঙ্খ ও শার্ঙ্গধনু এবং দুই ডান হাতে চক্র ও পঞ্চবাণ।
জগদ্ধাত্রী পূজা ২০২৩ (Jagadhatri Puja 2023) উপলক্ষ্যে অসংখ্য মানুষের ভিড় কৃষ্ণনগর, চন্দননগরে। গলি থেকে রাজপথ শুধু আলো আর আলো। কোনও কোনও মণ্ডপে ঢোকার গেটে নানা থিমের বাহারি আলো। কোথাও পুরো মণ্ডপ জুড়ে আলোর কারিকুরি। জগদ্ধাত্রী পুজোয় চন্দননগরের আলোর রোশনাইয়ের অমোঘ আকর্ষণেভিড় করছেন স্থানীয়-ভিনজেলার বহু মানুষ। ইতিহাস অনুযায়ী কৃষ্ণনগরে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজা (Jagadhatri Puja) চালু হলেও বর্তমানে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতেই মূলত মানুষজন ভিড় করে থাকেন। তবে কৃষ্ণনগরেও জগদ্ধাত্রী পূজাতে ভিড় করেন ভক্তরা। দেখে নিন চন্দননগর, ভদ্রেশ্বরের ও কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত কিছু জগদ্ধাত্রী পুজোর রূপ, সাজসজ্জা,ইতিহাস।
কৃষ্ণনগরের বুড়িমা : বলা হয় কৃষ্ণনগরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় প্রথম শুরু করেন জগদ্ধাত্রী পূজা। সেই কৃষ্ণনগরের বুড়িমার জগদ্ধাত্রী পুজোকে বেশ জাগ্রত বলে মনে করা হয়। সেই পুজোর টানে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ জড়়ো হন মণ্ডপে। ২০২৩ এ ২৫১ বছরে পা দিল কৃষ্ণনগরের বুড়িমা। বিশ্বাস করা হয় বুড়িমার প্রসাদ মুখে দিলে মনস্কামনা পূরণ হয়। মায়ের অপূর্ব সাজের টানেও মানুষ আসেন বুড়িমা দর্শনে। অনেকে বলেন ১২ কেজি গহনা দিয়ে সাজানো হয় মাকে। আবার কেউ বলেন ৯ কেজি গহনায় সাজেন মা। তবে শুধু দেবী দর্শন নয়, দেবীর ভোগ পাওয়ার জন্যও ভক্তদের মধ্য়ে উৎসাহ থাকে চোখে পড়ার মতো। পুজো উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এবার অন্তত ৩০-৩৫ হাজার দর্শনার্থী এই মহাপ্রসাদ গ্রহণের সুযোগ পাবেন। মাকে নিবেদন করার পর তা মহাপ্রসাদ বলে গণ্য করা হয়। সেই মহাপ্রসাদ এরপর ভক্তদের মধ্য়ে বিতরণ করা হয়। প্রায় ৫০ কুইন্টাল চাল, ২ কুইন্টাল দারচিনি, ১৩ কুইন্টাল ঘি এই ভোগ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও এলাচ, কাজু, কিসমিসও লাগে মায়ের মহাপ্রসাদের জন্য।
ভদ্রেশ্বরের গৌড়হাটি তেতুঁলতলা সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পুজো: কথিত রয়েছে, এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুচর দাতারাম সুর। এমনও শোনা যায়, এক সময় আর্থিক অনটনের কারণে এই পুজো বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। শুধু জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়ে নয়, এখানে স্থায়ী মন্দিরে নিত্য পুজো হয়। এছাড়া শনিবার ও রবিবার হয় বিশেষ আরতি। ২৩১ বছরে পা দেওয়া এই পুজোর আগে ভক্তরা দেবীকে বেনারসি শাড়ি দেন। ভক্তদের দেওয়া প্রায় ২০০ বেনারসি শাড়ি দেবীকে পরানোর রীতি রয়েছে এখানে। এছাড়াও মায়ের সজ্জায় থাকে কয়েকশো ভরির গয়না। নবমীতে খিচুড়ি ও পোলাও সহ নানান পদের ভোগ খেতে আসেন হাজার হাজার মানুষ। তবে এই পুজোর সবচেয়ে উল্লেখযাগ্য দিক হল, এখানে মায়ের বরণ করেন পুরুষরা। বহুদিন ধরে দশমীর দিন শাড়ি, শাখা ও সিঁদুর পরে পুরুষদের দেবীকে বরণ করার রীতি রয়েছে।
চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে চাউলপট্টির জগদ্ধাত্রী পুজো : ‘আদি মা’ বা ‘বড় মা’ হিসাবে পরিচিত চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে চাউলপট্টির জগদ্ধাত্রী পুজো। স্থানীয়দের বিশ্বাস, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন। এখানে ঠাকুরের বাঁ দিকে মুখ করে থাকে হাতি এবং বাহন সিংহের রং হয় সাদা। ষষ্ঠীর দিন চালের পায়েস, অষ্টমীতে খিচুড়ি ও নবমীতে পোলাও ভক্তদের বিতরণ করা হয়। ২০২৩ বছর ২৫৮ বছরে পড়ল চাউলপট্টির জগদ্ধাত্রী পুজো। এছাড়াও এখানে প্রতিমার শাড়ি দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। কয়েক কুইন্টাল ফল চন্দননগর হাসপাতাল ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। দেবীকে সোনা ও রূপোর গয়নায় সাজিয়ে তোলারও রীতি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট পুজো কমিটির তরফে জানা গিয়েছে, এখানে মাকে সাজানো হয় ১০০ ভরির গয়না দিয়ে। বহু ভক্তের মনস্কামনা পূরণ হওয়ায় তাঁরা দেবীকে শাড়ি ও গয়নাও দেন।
বোড় চাঁপাতলা যুব সম্প্রদায় জগদ্ধাত্রী পুজো : চন্দননগরের বোড় চাঁপাতলা যুব সম্প্রদায় জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটি ৬১ তম বর্ষে তাঁদের থিম ইতিহাসের ইতিকথা। মণ্ডপসজ্জায় তুলে ধরা হয়েছে চন্দননগরের নানান ইতিহাস। পর্তুগীজ, ডাচ, ডেনিস, ফরাসি থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশে এক সময় মিনি ইউরোপ ছিল গঙ্গার পশ্চিম পারে হুগলি জেলা। চন্দননগরেও বাণিজ্যর জন্য এসেছিল তারা। সেই সব ইতিহাসের কথাই তুলে ধরা হয়েছে এই মণ্ডপসজ্জায়। এছাড়া মেহগনি গাছের গুঁড়িকে প্রায় নয় মাস ধরে কেটে কেটে নিখুঁত ভাবে তৈরি করা হয়েছে এই জগদ্ধাত্রী প্রতিমা।
ভদ্রেশ্বর বাবুর বাজারের জগদ্ধাত্রী পুজো : ৫০ তম বর্ষে পদার্পণ করেছে এই পূজো। এ বছরে তাদের থিম 'ঘুমোরের ঘটা'। রাজস্থানী নৃত্যের উপরে এই মণ্ডপ নির্মাণ করা হয়েছে। রাজস্থানের বাড়ি বা হাভেলিকে মণ্ডপে দেখানো হয়েছে। রাজস্থানী নৃত্যের ভঙ্গিকে মডেলের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি, রাজস্থানের আবহকে তুলে ধরার জন্য রাজস্থানী ঘরনার গান ও বাজানো হচ্ছে মণ্ডপে। উদ্যোক্তাদের দাবি, লোকনৃত্য আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই লোকনৃত্যকে তুলে ধরার জন্য আমাদের এই ভাবনা।
চন্দননগর বোরপঞ্চানন তলার জগদ্ধাত্রী পুজো : এ বছর ৫০ বছরে পদার্পণ করেছে এই পুজো। এ বছরে তাঁদের থিম আস্তিক। মণ্ডপের প্রবেশদ্বারে উপরে রয়েছে উইন্ড চ্যান্ট। যা একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি করছে বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। মণ্ডপে প্রবেশের পরেই দেখা যাবে চারটি পুরুষ ও চারটি নারী মূর্তি। প্রায় এক হাজার প্রদীপ ব্যবহার করা হয়েছে মণ্ডপে। যা তাদের সত্তাকে তুলে ধরছে বলে দাবি উদ্যোক্তাদের।
জগদ্ধাত্রী পুজো মানে প্রথমেই যে জায়গার কথা বেশিরভাগ মানুষের মাথায় আসে, তা হল হুগলির চন্দননগর। ঐতিত্যের পাশাপাশি থিমের ছোঁয়াও দেখা যায় চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোয়। আর সেই সমস্ত থিম মন জিতে নেয় দর্শনার্থীদের। এবারেও তার ব্যতিক্রম নেই। দর্শনার্থীদের সুবিদার্থে এবার জগদ্ধাত্রী পূজার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে বিশেষ ট্রেনেরও। চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষ্যে বিশেষ ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পূর্ব রেল। হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল এবং বর্ধমান শাখায় এই বিশেষ ট্রেনগুলো চালানো হবে সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। চারদিনে মত দশটি স্পেশাল ট্রেন চলবে বলে খবর।
- Related topics -
- পুজো ও উৎসব
- চন্দননগর
- কৃষ্ণনগর
- জগদ্ধাত্রী পুজো
- রাজ্য