উৎসব ২০২৪

Devi Kali । কালীর কোন রূপের পুজো ডেকে আনতে পারে বিপদ? কোন রূপেই বা মা আশীর্বাদ দেন প্রাণখুলে? পড়ুন দশরূপে কালীকথা

Devi Kali । কালীর কোন রূপের পুজো ডেকে আনতে পারে বিপদ? কোন রূপেই বা মা আশীর্বাদ দেন প্রাণখুলে? পড়ুন দশরূপে কালীকথা
Key Highlights

“কু” ধাতু থেকেই 'কাল' শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ 'মহাকাল' অথবা 'মৃত্যু'। এই 'কাল' শব্দের পিছনে “ঈপ” প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে “কালী” পদটি। পন্ডিত শ্যামাচরণ ভট্টাচার্যের মতে, মহাকাল বা শিবের বিশেষ শক্তিই হচ্ছেন কালী। তন্ত্র পুরাণে দেবী কালিকার একাধিক রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। শাস্ত্র মতে, দেবীর আটটি রূপ। দক্ষিণকালিকা, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালিকা, শ্মশানকালিকা ও মহাকালী। বারোয়ারি পুজো, গৃহস্থের বাড়ির উদযাপন এবং বিভিন্ন মন্দিরে আরাধনা করা হয় কালীর বিভিন্ন রূপকে।

“কু” ধাতু থেকেই 'কাল' শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ 'মহাকাল' অথবা 'মৃত্যু'। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত - তিনটি কাল নিয়ে মহাকাল। এই 'কাল' শব্দের পিছনে “ঈপ” প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে “কালী” পদটি। পন্ডিত শ্যামাচরণ ভট্টাচার্যের মতে, মহাকাল বা শিবের বিশেষ শক্তিই হচ্ছেন কালী।সৃষ্টির আদিতে বিষ্ণু যখন যোগনিদ্রায় ছিলেন, বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয়। এই সময় বিষ্ণুর কর্ণকমল থেকে দুটি দৈত্য জন্মলাভ করেন। এই দৈত্য দুটির নাম ছিল মধু ও কৈটভ। এই দুই দৈত্য জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে, ব্রহ্মা মহাকালীর স্তব করতে শুরু করেন। ভক্তের ডাকে আদ্যা শক্তি মহামায়া কালী রূপে আবির্ভুত হন। আবার মার্কন্ডেয় পুরাণে, শ্রী শ্রী চন্ডী বলছে, শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই দৈত্যের অত্যাচারে দেবতারা ভীত হয়ে আদ্যাশক্তির আরাধনা করলে আদ্যাশক্তির দেহকোষ থেকে আবির্ভূতা হন দেবী ‘অম্বিকা’। তিনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হওয়ায় তার অপর নাম হয় 'কালী'। আবার, ত্রেতা যুগে রাবণের পুত্র মহীরাবনের সাধনায় তুষ্ট হয়ে দেবী ভদ্রকালী রূপে তাকে দেখা দেন। শাস্ত্ৰ মতে, দেবী করুণাময়ী। দেবতা, দৈত্য বা মানব, যিনিই তাঁর শরণ নেন, তাঁকেই রক্ষা করেন মহামায়া। 

দেবী কালীর বিভিন্ন রূপ :

তন্ত্র পুরাণে দেবী কালিকার একাধিক রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। শাস্ত্র মতে, দেবীর আটটি রূপ। দক্ষিণকালিকা, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালিকা, শ্মশানকালিকা ও মহাকালী। এছাড়াও বারোয়ারি পুজো, গৃহস্থের বাড়ির উদযাপন এবং বিভিন্ন মন্দিরে আরাধনা করা হয় কালীর বিভিন্ন রূপকে। নিচে এই রূপগুলির বর্ণনা দেওয়া হলো :

দক্ষিণাকালী : বাংলায় সবচেয়ে বেশি আরাধনা হয় দক্ষিণাকালীর। স্থানভেদে দেবীর এই রূপকে 'শ্যামাকালী' বলা হয়। এই মাতৃমূর্তির সারা শরীর গাঢ় নীল বর্ণের। তাঁর মূর্তি ক্রুদ্ধ। মা ত্রিনয়নী, মুক্তকেশী, মুণ্ডমালা বিভূষিতা। মায়ের বাম দিকের দুই হাতে থাকে নরমুণ্ড এবং খড়গ, ডান হাতে থাকে আশীর্বাদ এবং অভয় মুদ্রা। দেবী মহাদেবের উপরে দণ্ডায়মানা।

শ্মশান কালী : প্রাচীনকালে ডাকাতেরা দেবীর এই রূপের আরাধনা করত, সে কারণেই এই দেবীর আরেক নাম ডাকাতে কালী। দেবী শ্মশানবাসিনী। দেবীর গায়ের রং কাজলের মতো কালো, চোখ দুটি রক্ত পিঙ্গল বর্ণের। চুলগুলি আলুলায়িত, দেহভঙ্গী ভয়ংকর। বাঁ-হাতে মদ ও মাংসে ভরা পানপাত্র, ডান হাতে নরমুণ্ড। শ্মশানকালীর আরেকটি রূপে তার বাঁ-পা শিবের বুকে স্থাপিত এবং ডান হাতে ধরা খড়্গ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দেবী চৌধুরানী' উপন্যাসে এই দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। গৃহস্থ বাড়িতে কালীর এই রূপের পুজো করা নিষিদ্ধ । 

সিদ্ধকালী : সিদ্ধকালী কালীর একটি অখ্যাত রূপ। গৃহস্থের বাড়িতে সিদ্ধকালীর পুজো হয় না, তিনি মূলত সিদ্ধ সাধকদের আরাধ্যা। কালীর এই রূপ ভুবনেশ্বরী নামেও পরিচিত। কালীতন্ত্র-এ তাকে দ্বিভূজা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। দেবীর ডানহাতে ধরা খড়্গের আঘাতে চন্দ্রমণ্ডল থেকে নিঃসৃত অমৃত রস বামহস্তে ধরা একটি কপালপাত্রে পড়ছে। এই দেবী রক্ত নয়, অমৃত পান করে থাকেন।সিদ্ধকালীর দু'টি হাত, শরীর গয়নায় আবৃত। দেবীর ডান পা শিবের বুকে এবং বাঁ পা থাকে তাঁর দু'পায়ের মাঝখানে। 

ফলহারিণী কালী : গৃহস্থ বাড়িতে শান্তি বজায় রাখতে কালীর এই রূপের আরাধনা করা হয়। এই পুজোয় ফল মানত করা হয় বলে দেবীর এমন নাম।

 মহাকালী : তন্ত্রসার গ্রন্থমতে, মহাকালী পঞ্চবক্ত্রা ও পঞ্চদশনয়না। দেবীর দশটি মাথার মতো দশটি হাত এবং দশটি পা। তবে শ্রীশ্রীচণ্ডীতে তাকে আদ্যাশক্তি, দশবক্ত্রা, দশভূজা, দশপাদা ও ত্রিংশল্লোচনা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। তার দশ হাতে রয়েছে যথাক্রমে খড়্গ, চক্র, গদা, ধনুক, বাণ, পরিঘ, শূল, ভূসুণ্ডি, নরমুণ্ড ও শঙ্খ। দেবীর পায়ের তলায় অসুরের কাটা মুণ্ড থাকে। ভূত চতুর্দশীর দুপুরে এই দশমাথা মহাকালীর সাধনা করা হয়। এই প্রতিমায় শিব অনুপস্থিত। 

ভদ্রকালী : যিনি মরণকালে জীবের মঙ্গল বিধান করেন, তিনিই ভদ্রকালী। ভদ্রকালী নামটি শাস্ত্রে দুর্গা ও সরস্বতী দেবীর অপর নাম রূপেও ব্যবহৃত হয়েছে। কালিকাপুরাণ মতে, ভদ্রকালীর গাত্রবর্ণ অতসীপুষ্পের ন্যায়, মাথায় জটাজুট, ললাটে অর্ধচন্দ্র ও গলদেশে কণ্ঠহার। তন্ত্রমতে অবশ্য তিনি কাজলের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণা, কোটরাক্ষী, সর্বদা ক্ষুধিতা, মুক্তকেশী। তিনি জগৎকে গ্রাস করছেন, তার হাতে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ও পাশযুগ্ম।কালীর এই রূপ সাধারণত বারোয়ারি বিভিন্ন মন্দিরে পুজো করা হয়।

কাম্যাকালী : বিশেষ কোনো প্রার্থনা পূরণের উদ্দেশ্যে কালীর এই রূপের আরাধনা করা হয়। সাধারণত, অষ্টমী, চতুর্দশী অমাবস্যা পূর্ণিমা ও সংক্রান্তির মতো তিথিতেই কাম্যাকালীর আরাধনা করা হয়। মূর্তি এবং পুজোর নিয়ম দক্ষিণাকালীর স্বরূপ। 

চামুণ্ডা কালী : চামুণ্ডা হলেন 'আদিশক্তি'। তিনিই আবার 'ভগবতী দুর্গা'। দেবীভাগবত পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর বর্ণনা অনুযায়ী, চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই অসুরকে হত্যা করার জন্যে তিনি ‘চামুণ্ডা’ রূপে আবির্ভুতা হন। পার্বতী, চণ্ডী, দুর্গা, চামুণ্ডা ও কালী এক ও অভিন্ন রূপ। তার গাত্রবর্ণ নীল পদ্মের মত, হাতে অস্ত্র, দণ্ড ও চন্দ্রহাস।

শ্রী কালী : দেবী দুর্গা বা পার্বতীর আরেক রূপ শ্রী কালী। এই রূপে দেবী দারুক নামে অসুরকে বধ করেছিলেন। পুরাণ অনুযায়ী, কালীর এই রূপ মহাদেবের কণ্ঠের বিষ পান করে কৃষ্ণবর্ণা হন এবং পরবর্তীকালে মহাদেব শিশু রূপে স্তন্যপান করে দেবীর শরীর থেকে বিষ গ্রহণ করেন।

গুহ্যকালী : শাস্ত্রে কালীর এই রূপকে ভয়ঙ্করী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায় কালো। তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা। তাঁর গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা, কোমরে কালো রঙের বস্ত্র, গলায় নাগযজ্ঞোপবীত, মাথায় জটা ও অর্ধচন্দ্র। দেবীর কানে থাকে শবদেহরূপী অলংকার। দেবী নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা। বামহাতে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণহাতে অনন্ত নাগরাজ। বামে বসে আছে বৎসরূপী শিব, তিনি নব রত্ন ভূষিতা। তিনি সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদান করেন। 

 || ‘ওঁ খড়্গং চক্রগদেষুচাপপরিঘান শূলং ভুশুণ্ডীং শিরঃ| শঙ্খং সন্দধতীং করৈস্ত্রিনয়নাং সর্বাঙ্গভূষাবৃতাম্ || নীলাশ্মদ্যুতিমাস্যপাদদশকাং সেবে মহাকালিকাম্ | যামস্তৌৎ স্বপিতে হরৌ কমলজো হন্তুং মধুং কৈটভম্ ||’ – মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর শ্রী শ্রী মহাকালীর ধ্যানমন্ত্রে পাওয়া যায়, তিনি দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। শাক্ত মতে, কালীই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করেছেন। তিনি করুণাময়ী, আশীর্বাদপ্রদানকারিনী। ভক্তিভরে তাঁর পুজো করলে ভক্তদের সকল প্রার্থনা মঞ্জুর করেন তিনি। কালীপুজোর পুণ্য লগ্নে মায়ের দশরূপ স্মরণে কেটে যাক সব দুর্যোগ, আদিশক্তি মহামায়ার কাছে আমাদের এই প্রার্থনাই রইলো।