লাইফস্টাইল

মাঘ বিহুর ইতিবৃত্ত এবং উৎসব উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছাবার্তা | Details of Magh Bihu Festival in Bengali

মাঘ বিহুর ইতিবৃত্ত এবং উৎসব উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছাবার্তা | Details of Magh Bihu Festival in Bengali
Key Highlights

প্রাচীনকাল থেকেই আসাম জুড়ে মাঘ বিহু একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আদিকালে মাঘ বিহু ছিল বোরো জনগণের প্রধান উৎসব।

ভূমিকা | Introduction to Magh Bihu Festival

আনন্দ উপভােগ করবার এক একটি উৎসব প্রত্যেকটি জাতির মধ্যে বিদ্যমান । উৎসবের মধ্য দিয়ে সেই জাতির জীবনের একটি সামগ্রিক চিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় । উৎসব যখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ অংশ গ্রহণ করার সুযোগ করে দেয়, তখন তা জাতীয় উৎসবের রূপ ধারণ করে । 'বিহু' সেই অর্থে প্রকৃতই আসাম এর অতি জনপ্রিয় এক জাতীয় উৎসব রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিহু হল কৃষি প্রধান সমাজের উৎসব। ধরিত্রী দেবীর উর্বরতা ও সৃষ্টিশীলতার জন্য প্রার্থনাই হল এর মূল উৎস যা কিনা সকল দেশের আদিম সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বিহু হল বস্তুত এক ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। আসামের সকল অংশে জাতিগত ধর্ম বা ধর্মীয় পটভূমি নির্বিশেষে এই উৎসব উদযাপন করা হয় । আসামের চিরাচরিত এই বিহু উৎসব আজও সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত স্মৃতি বহন করে চলছে। আসামে মূলত তিন প্রকার বিহু উৎসব পালন করা হয়ে থাকে, এগুলি হল  যথাক্রমে ব’হাগ বিহু বা রঙ্গালী বিহু, কাতি বিহু বা কঙ্গালী বিহু এবং মাঘ বিহু বা ভোগালী বিহু।

বিহু উৎসবের উদ্ভব কাল এবং উৎপত্তি | Origin of the Magh Bihu festival

 ঠিক কোন সময়কাল থেকে আসামে বিহুর প্রচলন হয়েছে তা অতি প্রাচীন ইতিহাসের বিষয়বস্তু । তাই নিশ্চিত ভাবে এই উৎসবে যথার্থ সময় নির্দেশ করা না গেলেও বিশ্বাস করা হয় এবং পণ্ডিতেরাও একমত যে এই উৎসবের মূলে রয়েছে আদিম কৌম সমাজের বিশ্বাস ও সংস্কার। বিহু' শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন রকম মতবাদ বর্তমান , কিন্তু কোনো মতই সর্বসম্মত ভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। অধিকাংশ পণ্ডিতদের মতে সংস্কৃত 'বিষুবন' শব্দ থেকে বিহু শব্দের উদ্ভাবন ঘটেছে। বৈদিক 'বিষুবন' শব্দের অর্থ অনুযায়ী 'বিহু' হল বছরের এমন একটি বিশেষ ক্ষণ যে সময়ে দিন এবং রাত সমান হয়। প্রাণের উৎসব বলতে প্রত্যেকটি মানুষ যা বোঝে , প্রাণ ভরে ঐতিহ্যগত খাবার দাবার খাওয়া, ঐতিহ্যগত পোশাক পরা এবং ঐতিহ্যের শিকড়ে বেষ্টিত হয়ে থাকা নাচ ও গানের বিপুল আনন্দ উচ্ছ্বাসে মেতে থাকে তিন মাসের তিন ভিন্ন চরিত্রের বিহু উৎসব । কৃষি কে কেন্দ্র করেই উৎসবের প্রকৃত আনন্দ ঘিরে থাকে।

মাঘ বিহু | What is Magh Bihu festival

ভোগালী বিহু বা মাঘ বিহু প্রত্যেক বছর মাঘ মাসে পালন করা হয়। 'ভোগালী' শব্দটি ভোগ বা খাদ্য থেকে উৎপন্ন হয়েছে। মাঘ বিহু তিন দিন ধরে মহাসমারোহে পালন করা হয়। নিয়মানুসারে পৌষ সংক্রান্তির দিনের বিকেল বেলায়,যেটি উরুকা নামেও সুপরিচিত, যুবকেরা নদীর তীরে মাঠে উৎপাদিত শস্যের খড় সাজিয়ে ভেলাঘর নামক কুটির নির্মাণ করে থাকেন এবং তা দিয়ে রাত্রে মেজি নামক আগুন জ্বালিয়ে এই মাঘ বিহু উৎসব পালন করেন। নিশীথ কালে তারা মেজির চারিপাশে একত্রিত হয়ে বিহুগীতের সংগীত পরিবেশন করেন, ঢোল আদি বাদ্যযন্ত্র বাজান এবং সমবেতভাবে আহার করে থাকেন । পরবর্তী প্রহর অর্থাৎ সকালবেলায় তারা স্নানাদি সম্পন্ন করে মূল মাজিতে আগুন জ্বালান এবং ওই আগুনে পিঠা ও সুপুরি নিক্ষেপ করে থাকেন । এরপর সকলে মিলে তাঁরা অগ্নিদেবের কাছে প্রার্থনা জানান এবং তারপর সেই এলাকার ফলগাছগুলিতে শস্য বেঁধে দেওয়া হয়ে থাকে। উৎসবের সেই বিশেষ দিনটিতে সারাদিন ধরে চলে মোষের লড়াই, মোরগের লড়াই প্রভৃতি অভিনব ক্রীড়া প্রদর্শন। 

ইতিহাস | History of Magh Bihu festival

আহোম রাজার রাজত্বকালে  বর্ণাঢ্য এবং রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মাঘ বিহু পালন করা হয়েছিল বলে কথিত আছে। এই সময় রংঘড় প্রাঙ্গনে নানান রকমের ক্রীড়ার আয়োজন করা হয়ে থাকত। আহোম রাজা সেই স্থানে উপস্থিত থেকে এই উৎসব উপভোগ করে থাকতেন। সেই সময়কাল থেকে অসমে মহিষের যুদ্ধ, মোরগের যুদ্ধ ইত্যাদির বহুল প্রচলন হয়ে আসছে বলে অবগত হওয়া গেছে।

উরুকা | Uruka

বিহুর দিন স্থানীয় যুবকেরা খড় দিয়ে মেজিঘড় তৈরী করে। সকলে একত্রিত হয়ে ভোজন করে ও বিহুগীত পরিবেশন করে। উজনি অসমে মেজিঘড়কে হারলিগড় বা ভেলাঘড় বলা হয়।

উরুকায় মৎস ধরার রীতি | Fishing rule in Uruka

এই উৎসবের রীতি অনুযায়ী ,মাঘ বিহুর উরুকা দিনে নির্দিষ্ট পুকুর, খাল বা অন্য কোন জলাশয় থেকে সকলে একত্রে মাছ ধরেন যা এ উৎসবের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে মানা হয় । জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এই মাছ ধরার রীতি উদযাপন করে আনন্দ উপভোগ করেন। এই প্রথা অনুসারে সকলে পুকুর, খাল বা অন্য জলাশয় থেকে যে মাছ ধরে সেই আহরণ করা মৎস দ্বারা সকলে রাত্রের ভোজন করে থাকেন।

উরুকার রাত্রের রীতি | Uruka's nightly ritual

উরুকার এই উৎসব মুখর রাত্রে স্থানীয় যুবকেরা অন্যের গৃহ থেকে শস্য, ক্ষেত থেকে ফসল চুরি করে আনে।এই উৎসবে এটাই হল চিরাচরিত পরম্পরা।যেহেতু এই উৎসবে চুরি করার প্রথা বর্তমান, এই বিহুকে 'চোর বিহু' নামেও জানা যায়।

বিহুর রীতি | Bihu style

উৎসবের দিন সকালে স্নান করে মেজিতে আগুন লাগানো বহু প্রচলিত রীতি । আগুন প্রজ্বলিত করা হয় এবং সাথে সাথেই মন্ত্র উচ্চারণ করে মুগডাল, ঘি, চাল ইত্যাদি অগ্নিতে অর্পণ করা হয়।মেজিতে আগুন প্রজ্বলিত করে অগ্নিদেবকে প্রসন্ন করার জন্য নিম্নের মন্ত্রটি উচ্চারণ করা হয়-

"অগ্নিং প্রজ্জ্বলিতং বন্দে চতুর্ব্বেদং হুতাশনং৷

সুবর্ণ-বর্ণমমলং জ্যোতি রূপায় তে মন:৷৷"

উপরোক্ত রীতি সমাপ্ত হওয়ার পর ভোজ-ভাত খাওয়া হয়। গুরুদেব ও ভক্তদের গৃহে নিমন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। তারপর তাঁদের নতুন ধান দিয়ে প্রস্তুত জলপান পরিবেশন করে তাঁদের আশীর্বাদ নেওয়া হয়ে থাকে।

বিহুর খাদ্য | Bihu food

মাঘ বিহুকে 'ভোগালী' অর্থাৎ ভোজনের উৎসব বলে ও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই বিহুর সময়ে অসমবাসীরা জলপান, পিঠে, নানা ধরনের নাড়ু ইত্যাদি প্রস্তুত করে থাকেন। তিলের তৈরি পিঠে হল মাঘ বিহুর প্রধান মিষ্টান্ন । মাঘ বিহুর সময় প্রস্তুত করা বিভিন্ন পিঠেরর মধ্যে অন্যতম হল : চুঙ্গা পিঠা, ঘিলা পিঠা, সুতুলি পিঠা, হেঁচা পিঠা, ডেকা পিঠা, ভুরভুরী পিঠা প্রভৃতি সব সুস্বাদু পিঠার সমাহার। তাছাড়াও এই বিশেষ উৎসব উপলক্ষ্যে ভাজা চাউল, কোমল চাউল, চিড়া, সন্দেশ, মুড়ি, খৈ ইত্যাদি জলপানের জন্য যত্ন সহকারে প্রস্তুত করা হয়ে থাকে।

মাঘ বিহু উপলক্ষে শুভেচ্ছাবার্তা | Greetings on the occasion of Magh Bihu

  •  বিহু-র আনন্দময় পরিবেশে আপনাকে ও আপনার পরিবারের সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।
  • মাঘ বিহুরে উৎসবমুখর মুহূর্ত নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছে, নতুন আরম্ভ, নতুন আশাকে অভিনন্দিত করছে। সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা এবং এই আশা রাখি যাতে বিহু নিয়ে আসে সকলের ঘরে ঘরে আনন্দ ও সুখের সমাহার!!
  • কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই আনন্দময় উৎসব ,মাঘ বিহু যেমন প্রকৃতিকে স্বচ্ছলতা এবং শস্যের সমাহারে ভরিয়ে তোলে তেমনি সমাজে ও প্রাচুর্য্য এবং সৌন্দর্যের উদযাপন হোক প্রতিটি ঘরে ঘরে !!
  • বিহুরে লগন মধুরে লগন, অকাশে বাতাসে লাগিল রে, চম্পা ফুটিছে, চামলী ফুটিছে, তার সুবাসে ময়না আমার ভাসিল রে, সকলকে জানাই মাঘ বিহু র আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন । সমৃদ্ধময় ও সুখময় হোক নতুন বছর !!
  • জগত জুড়ি বিহুর পরব খুসি যে ছ​ড়ায়; বসন্তে এই বিহুর লগন উত্তাল হয়ি যায়।" ~বিহুর আনন্দময় মুহূর্তে সকলের মনে লাগুক সুখের পরশ... প্রতিটি ঘরে থাকুক সমৃদ্ধি ও ভরপুর স্বচ্ছলতা!! মাঘ বিহু র আন্তরিক অভিনন্দন আপনাকে ও আপনার পরিবারকে ।

ফাগুনেরও মোহনায় মন মাতানো মহুয়ায়, রঙ্গীন এ বিহুর নেশা কোন আকাশে নিয়ে যায়"...বিহুর নেশা লাগুক সবার অন্তরে ...ভালোবাসায় ভরে উঠুক প্রতিটা মুহূর্ত। শস্য শ্যামলা ধরিত্রীতে লাগুক পরিপূর্ণতা ছোঁয়া ...মাঘ বিহু উপলক্ষ্যে সকলকে জানাই আন্তরিক ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। 

পরিশিষ্ট | Conclusion

মাঘ বিহু র মতো আনন্দমুখর একটি উৎসব হল যথার্থই কল্যাণ এবং মিলনের উৎসব। নতুন বছরের পূর্বাভাগে উদযাপিত এই উৎসবে প্রতিদিনের মালিন্য দূর করে, আত্মপরায়ণ জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডী ত্যাগ করে বৃহত্তর কল্যাণের জন্য জাতি ধর্মনির্বিশেষে সকল মানুষ একত্রে মিলিত হন। । কৃষিপ্রধান এই অসমীয়া উৎসব তাই আজ সকলের প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে।