ইতু পূজার ইতিবৃত্ত | Details of Itu puja in bengali
ইতুর এক নাম মিত্র। অগ্রহায়ণ মাসে সূর্য মিত্র নামেই পরিচিত। প্রতি রবিবার উপবাস রেখে পুজো করা হয় বলে একে সূর্যের পুজোও বলা হয়ে তাকে। অবশ্য ইতু পুজোকে সূর্য উপাসনা বলা হলেও এই পুজোর রীতিও উপাচার বিশ্লেষণ করে ইতুকে মাতৃদেবী রূপেই গণ্য করেন অনেকে।
ভূমিকা | Introduction to Itu puja
ক্রমশ উন্নতি প্রাপ্ত প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার ঐতিহ্যময় ব্রতকথা এবং লোকাচার। তবুও বাংলার গ্রামে, মা-ঠাকুমারা এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন এই ব্রতকথার মাহাত্ম্যকে তাঁদের আধ্যাত্মিকতা ও বিশ্বাস দিয়ে । ইতু পুজো হল সেইরকমই একটি অতি জনপ্রিয় এবং পরিচিত ব্রতপালন।
ইতু পূজা প্রকৃতপক্ষে বাংলার একটি লোকউৎসব যা অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার ইহলোকে শস্য বৃদ্ধির কামনায় ও পরলোকে মোক্ষ লাভের ইচ্ছায় ইতু বা ইঁয়তি অর্চনা করা হয়ে থাকে। সাধারণত কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিনে ইতু পুজোর সূচনা হয়।এক সংক্রান্তি থেকে আরেক সংক্রান্তি পর্যন্ত এই পুজো চলে। কেউ কেউ পয়লা অগ্রহায়ণেও এই পুজো করেন।
অধিকাংশ বাঙালির ঘরে ঘরে এই পুজো আয়োজিত হয়ে থাকে। কথিত আছে যে ইতুর বরে ধন-সম্পদ ও সৌভাগ্য বৃদ্ধি হয়।
আক্ষরিক অর্থ | The lexical meaning of Itu puja
'ইতু' শব্দটি মিতু বা মিত্র থেকে উৎপত্তি হয়েছে । মিত্র শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল সূর্য। আবার অনেকে মনে করেন যে 'আদিত্য' শব্দ অপভ্রংশ হয়ে 'ইতু' শব্দের সৃষ্টি। বাংলা পঞ্জিকা মতে অগ্রহায়ণ মাসে সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করে আর এই অবস্থানে সূর্যের নাম মিত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । এই সত্যটি উদ্ঘাটন হওয়ার পর থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে ইতু পুজোর প্রচলন শুরু হয়। সুতরাং এককথায় বলা যায় ইতু পূজা মানে সূর্য পূজা।তবে, ইতিহাসের এক অন্য আঙ্গিক অনুযায়ী ইতু হলেন প্রাচীন ইন্দ্রপূজার দৃষ্টান্ত। ঋকবেদীয় সূক্তগুলোর নাম ইন্দ্রস্তূপ এবং সেখান থেকে এসেছে ইতু নামটি। বলা হয়ে থাকে যে মেয়েরা ইন্দ্রের মতো স্বামী পাওয়ার বাসনায় ইন্দ্রদ্বাদশীর দিন ইতু পূজা করে থাকে । তবে প্রধানত বঙ্গ ললনারা ইতুকে শস্যের দেবী হিসেবেই মান্য করে এবং সেই হিসেবেই পূজা করে থাকে।
পূজা সম্পর্কীয় পৌরাণিক কাহিনী | Myth about Itu Puja
এই ব্রত কুমারী, সধবা, বিধবা সবাই করতে পারেন। তবে এই ব্রতের পেছনে এক অতি লোকপ্রিয় ও প্রচলিত কাহিনী আছে। এক দেশে এক গরীব ব্রাহ্মণ তার স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকত। ব্রাহ্মণ ভিক্ষা করে যা আদায় করত তা দিয়েই চলত তার সংসার।বামুনের একদিন মনে সাধ জাগে পিঠে খাবার । তাই অতি কষ্টে সে ভিক্ষা করে চাল, নারকেল, গুড়, তেল সব সামগ্রী জোগাড় করে বামুনিকে পিঠে বানাতে বলে আর তার সাথে এও বলে দেয় যেন কাউকে একটাও পিঠে না দেওয়া হয়। এর পর বামুন রান্নাঘরের পিছনে আড়ালে বসে থাকে, আর বামুনি যেই কড়াতে একটা করে পিঠে ভাজে ,অমনি তার "ছ্যাক" "ছ্যাক" শব্দে বামুন দড়িতে একটা করে গিট বাঁধতে থাকে আর এ ভাবে কতগুলো পিঠে হোলো তা গুনে রাখে।এর পর বামুনী যখন তার স্বামীকে পিঠে খেতে দেয় তখন বামুন দড়ির গিঁট খুলতে খুলতে খেয়াল করে যে দুটো পিঠে কম পড়ছে। বামুন তা দেখে মারাত্মক রেগে যায় এবং স্বামীর রাগ দেখে বামুনি ভয়ে তার দুই মেয়েকে দুটো পিঠে দেবার কথা বলে ফেলে। তা শুনে বামুন তার দুই মেয়ে, উমনাে আর ঝুমনাে কে তাদের মাসির বাড়ি রেখে আসবে বলে মনস্থির করে।যেমন ভাবা তেমনি কাজ।পরের দিন ভোরের বেলা উমনো আর ঝুমনোকে সঙ্গে করে বামুন বাড়ি থেকে রওনা দেয় । সেই দিনটি ছিল কার্তিক মাসের সংক্রান্তির আগের দিন।সারা দিন চলতে চলতে তারা সকলে মিলে একটি জঙ্গলে এসে উপস্থিত হয় আর সেখানে তাদের বাবা, মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। গভীর রাতে বাঘ,ভালুক এর গর্জনে উমনো আর ঝুমনোর ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকার জঙ্গলে নিজেদের একা পেয়ে আতঙ্কে এবং ভয়ে তারা খুব কাঁদতে থাকে আর কাতর স্বরে ভগবানকে ডাকতে থাকে। শেষে তারা এক বট গাছের কাছে এসে হাত জোড় করে দুজনে বলে “হে বট বৃক্ষ! মা আমাদের দশ মাস দশ দিন গর্ভে স্থান দিয়েছেন। তুমি আজ রাতের জন্য তোমার কোটরে স্থান দাও।”
মেয়ে দুটির আকুল আবেদন শুনে বট গাছ দু ফাঁক হয়ে যায় আর তারা দুইবােনে গাছের কোটরে রাত কাটায়। সকাল হলে তারা বট গাছকে প্রণাম করে জঙ্গলের পথ ধরে চলতে শুরু করে। কিছুদূর চলতে চলতে তারা দেখে সামনে একটা বাড়ি যেখানে মাটির সরা করে কয়েকজন মেয়ে পুজো করছে। বাড়ির কাছে পৌঁছলে দুটো ফুটফুটে মেয়ে দেখে বাড়ির গৃহকর্ত্রী তাদের থেকে সব কথা জানতে চান, তখন দুই বোনে কাঁদতে সব কথা খুলে বলে। উমনো আর ঝুমনো তখন গিন্নিমা র কাছে জানতে চায় বাড়ির মেয়েরা ঘটে করে কি পূজা করছে, গিন্নি মা উত্তরে জানান যে সেই পুজোর নাম হল ইতু পুজো। আগের দিন উপােষ করে থাকলে তবেই এই পুজো করা যায়। এই কথা শুনে উমনাে ঝুমনাে গিন্নি মাকে জানায় যে আগের দিন থেকে তারা অনাহারেই আছে। তখন গিন্নি তাদের জন্য পুজোর জোগাড় করে দেয় আর তারাও কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে ইতু পুজো করতে শুরু করে । উমনো আর ঝুমনোর নিস্পাপ ভক্তি দেখে ইতু ভগবান অর্থাৎ সূর্যদেব তাদের বর প্রার্থনা করতে বলে। তখন তারা সূর্য দেবের কাছে তাদের বাবার দুঃখ দূর করার প্রার্থনা জানায়।
সূর্যদেব তাদের মনস্কামনা পূরণ হবার আশীর্বাদ করেন এবং তারপর থেকে তারা অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবারে ভক্তি সহকারে ইতু পুজো করে আর সূর্য দেবের কাছ থেকে আশীর্বাদ পেতে থাকে। এদিকে ব্রাহ্মণের ঘর শস্যে , ধানে পরিপূর্ণ হলেও ব্রাহ্মণীর মনে হাসি নেই। মেয়েদের দুশ্চিন্তায় সে খালি চোখের জল ফেলে । এমন ই সময় উমনো আর ঝুমনো বাড়ি ফিরে আসে; মেয়েকে দেখে ব্রাহ্মণের আনন্দের শেষ থাকে না। তারা বাবা মাকে জানায় যে ইতু পুজো এবং সূর্যদেবের আশীর্বাদের ফলেই তাদের পরিবারের এত সচ্ছলতা এসেছে। সব শুনে ব্রাহ্মণীও ইতু পুজো শুরু করে দেয় এবং তাদের স্বচ্ছলতা আরও অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এ ভাবেই ইতু পুজোর মাহাত্ম্য সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।
পুজোর বিধি | Itu Puja rules
শীতকালীন চাষের আগে রবিশস্যের বীজ সংগ্রহই ছিল ব্রতপালনের উৎস। একবার ব্রত শুরু করলে পালন করতে হয় তা আজীবন। যতদিন না ব্রতপালনের ভার তার মেয়ে বা পুত্রবধূ নিচ্ছে, ততদিন ব্রতধারীকে পালন করতেই হবে ইতুপুজো।
ইতু পুজোর মন্ত্র | Itu Puja Mantra
“ইঁয়তি ইঁয়তি নারায়ণ,
তুমি ইঁয়তি ব্রাহ্মণ।
তোমার শিরে ঢালি জল,
অন্তিম কালে দিও ফল।"
ইতু পূজার সময় ইতুর ঘটে দুধ ও গঙ্গাজল জল ঢালা হয়- “নামো ইতু লক্ষ্মী দেব্যায় নমঃনমো সূর্য দেব্যায় নমঃ” বলা হয়ে থাকে।
পুজোর উপকরণাদি | Itu puja ingredients
একটি সুন্দর মাটির খোলার ভেতরে মাটি ভরে তার ভিতরে মান, কচু, কলমীলতা, হলুদ, আখ, শুষনি, সোনা ও রুপোর টোপর রাখা হয় ।এ ছাড়াও জামাই-নাড়ু, শিবের জটা, কাজললতা রেখে ফুলের মালা, ধূপ-দ্বীপ-সিঁদুর ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পুজোর উপকরণ ও ফল-মিষ্টি ও নবান্ন সহযোগে ইতু পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। নতুন গুড় চাল ও দুধ দিয়ে পরমান্ন তৈরি করে ইতু লক্ষীকে নিবেদন করা হয়।
ইতু পুজোকে সূর্য উপাসনা বলা হলেও এই পুজোর রীতিও উপাচার বিশ্লেষণ করে ইতুকে মাতৃদেবী রূপেই গণ্য করেন অনেকে।
ইতু পুজোর ঘটের বিবরণ | Details of the Itu Puja pot
মাটির ছোট ঘটকে লাল সাদা রঙে সাজানো হয়। তাতে দেওয়া হয় গোবর মেশানো মাটি। সেখানে বীজ বপন করা হয়।চারাগাছ অঙ্কুরিত হলে ধরে নেওয়া হয় তা সংসারের সুখ সমৃদ্ধির প্রতীক।ইতুর ঘটের গায়ে পুতুলি আঁকা এবং ভেতরে দেওয়া হয় শস্যদানা ও তৃণগুচ্ছ। খড়ের বিঁড়ের উপরেই ইতুর সরাকে বসানো হয়। এর পর ওই সরাতে দেওয়া হয় মাটি। মাটি পূর্ণ সরার মাঝে ঘট স্থাপন করতে হয়। আর বাকী অংশে থাকে কলমী, সরষে, শুষনীর মূলসহ শাক। এ ছাড়া ধানের বীজ, মানকচুর মূল লাগানো হয়। আর ছোলা ,মটর ,মুগ, তিল, যব সহ আট রকমের শস্যের বীজও ছড়ানো হয়ে থাকে।
আহারের বিধি | Rules of eating during Itu Puja
পুজোর দিন ব্রতধারীকে তেল ও হলুদ ছাড়া সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবার খেতে হয়। সকালে পুজো হয়ে গেলে ফল এবং পুজোর প্রসাদ খাওয়া যায়। দুপুরে সিদ্ধ ভাত আর রাত্রেবেলা ময়দা (পরোটা কিংবা লুচি), মুড়ি খাওয়া যায়।এইদিন মুড়ি মাখিয়ে খেতে নেই; শুকনো খেতে হয়। দিনের মধ্যে একবার অন্ন খেতে হয়। ইতু পুজো মানেই পিঠেপুলি, পায়েস খাওয়ার ধূম পড়ে যায়। কোথাও কোথাও ইতু পুজো ঘিরেই হয় নতুন ধানের উৎসব নবান্ন। ইতুকে সাধভক্ষণের প্রথাও রয়েছে কোথাও কোথাও। সেদিন নতুন গুড় ও চাল দুধ দিয়ে পরমান্ন তৈরি করে নিবেদন করা হয়।ইতু লক্ষ্মীর কৃপার ফলে সবরকম সংকট ও বিপদ থেকে মুক্তি লাভ হয় এবং ধন,ধান্য , সৌভাগ্য ও স্বর্গ সুখ প্রাপ্তি হয়।
ইতু লক্ষ্মীর বিসর্জন | Itu Lakshmi's abandonment
পোড়া মাটির সরায় মাটি দিয়ে মটর, শুষনীশাক, কলমীশাক, মানকচু গাছ পুঁতে সারামাস তার লালন করা হয়। মাস শেষে সংক্রান্তির দিন গঙ্গা, নদী বা কোনো পুকুরে ইতু বিসর্জন হয়।
পরিশিষ্ট | Conclusion of Itu Puja
ইতু হলেন সূর্যদেব ও দেবরাজ ইন্দ্রের সংযুক্তিতে গড়ে ওঠা এমন এক দেবী যিনি নিতান্তই লৌকিক, যার হাতে গৃহস্থ রমনীরা তুলে দিয়েছেন কৃষি এবং সম্পদের সুখ ও সমৃদ্ধির ভার ।ইতু লক্ষ্মীর এই নারীর রূপ তাই মঙ্গলের প্রতীক। দেবী নিজ জ্যোতির দ্বারা অন্ধকার মোচন করেন এবং কিরণের দ্বারা সমস্ত বিশ্ব জগৎ প্রকাশ করেন। মা লক্ষ্মীরই আরেক রূপ ইতু দেবীর কাছে তাই আমাদের প্রার্থনা যেন তাঁর আশীর্বাদে সর্বপ্রকার দরিদ্রতা নষ্ট হয়, সকলের পাপ, রোগ ও দুঃস্বপ্ন দূরীভূত হয়।
- Related topics -
- লাইফস্টাইল
- ইতুপুজো
- সূর্য
- সূর্যালোক