Bengali Sweets | জামাই 'ঠকাতে' জলভরা মিষ্টি বানান সূর্যকুমার মোদক! সেই মিষ্টিকে GI ট্যাগ দিতে উদ্যোগ রাজ্যের! জানুন হুগলির বিখ্যাত কিছু মিষ্টি সম্পর্কে!
হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বরের তেলেনীপাড়ায় ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমিদার বাড়ির আবদারে জামাইদের ঠকাতে জলভরা মিষ্টির জন্ম। অন্যদিকে, মতিচুর সন্দেশের নাম দেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বিশ্বজুড়ে বাংলা-বাঙালির যেমন সুনাম, তেমনি সুনাম বাংলার মিষ্টি (Bengali Sweets) এর। বাংলার মিষ্টি বলতেই প্রথমে যেসব মিষ্টির নাম মাথায় আসে তার মধ্যে অন্যতম জলভরা সন্দেশ। ১৮১৮ সালে ইংরেজ আমলে হুগলি জেলায় তৈরি হয় এই জনপ্রিয় মিষ্টি। এবার এই জলভরা সন্দেশকেই বিশেষ তকমা দিতে উদ্যোগী রাজ্য । জানা গিয়েছে, চন্দননগর (Chandannagar) এর বিখ্যাত মিষ্টি জলভরা যাতে জিআই ট্যাগ তালিকা (GI Tag List) এর অন্তর্ভুক্ত হয়, তার জন্য উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য। এ খবর জানিয়েছেন, ভদ্রেশ্বরের তেলেনিপাড়ার অন্যতম মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান সূর্য মোদকের বর্তমান কর্ণধার শৈবাল মোদক।
জলভরা ও জিআই তকমা :
সম্প্রপ্তি আরামবাগের সভামঞ্চ থেকে জলভরার প্রশংসা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Chief Minister Mamata Banerjee)। তিনি স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, তাঁর সূর্য মোদকের মিষ্টি খুব ফেভারিট। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে সূর্য মোদকের নাম আনায় আপ্লুত দোকানের কর্ণধার। জলভরা যাতে পশ্চিমবঙ্গের জিআই ট্যাগ (Gi Tag of West Bengal) তকমা পায় তার জন্য চেষ্টা করছেন মুখ্যমন্ত্রী। শৈবাল মোদক বলেন,২০২২ সালে তারা জলভরা মিষ্টির জিআই ট্যাগ তালিকা (GI Tag List)-এর অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করেছেন। এসডিও-র কাছে এই সংক্রান্ত কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। তবে শুধু সূর্য মোদক নয়, চন্দননগর (Chandannagar) এর অন্যান্য মিষ্টির দোকানেও জলভরা পাওয়া যায়। সূর্য মোদকের কর্ণধার জানান, জিআই পেলে জলভরা তখন চন্দননগরের হয়ে যাবে। এছাড়াও মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন একটি জলভরা হাব তৈরির বিষয়েও। শীঘ্রই এ নিয়ে একটি বৈঠক হবে বলে জানান শৈবাল মোদক।
হুগলির বিখ্যাত কিছু মিষ্টি | Some of Hooghly's Famous Sweets :
বাংলার মিষ্টি (Bengali Sweets) গোটা বিশ্বে বিখ্যাত। পশ্চিমবঙ্গের এক এক জেলার এক এক মিষ্টি জনপ্রিয়। এর মধ্যে অবশ্যই প্রথম দিকে উঠে আসে হুগলির নাম। কেবল জলভরাই নয়, হুগলির আরও একাধিক মিষ্টি গোটা বিশ্বে বেশ জনপ্রিয়। আর এই মিষ্টিগুলির পেছনে রয়েছে না জানা 'মিষ্টি' ইতিহাসও। দেখে নেওয়া যাক হুগলির বিখ্যাত কিছু মিষ্টি সম্পর্কে।
জলভরা :
পশ্চিমবঙ্গের মিষ্টি (West Bengal Sweets) এর মধ্যে অন্যতম জলভরা। এই মিষ্টির এক ভারী সুন্দর ছদ্ম নাম আছে যা হয়তো অনেকের অজানা, তা হলো ‘জামাই ঠকানো মিষ্টি’। আর সত্যি বলতে সেই উদ্দেশ্যেই কিন্তু এর জন্ম। হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বরের তেলেনীপাড়ায় ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমিদার বাড়ি। ১৮১৮ সালে জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে প্রথম জামাই আসে জমিদার শ্বশুরবাড়িতে। এদিকে জমিদার বাড়ির অন্দরমহল থেকে দাবি উঠলো, জামাইষষ্ঠীতে তৈরী করতে হবে এমন মিষ্টি, যা হবে অভিনব এবং জামাই ঠকানো। এককথায় এমন এক মিষ্টি বানাতে হবে , যা খেতে গিয়ে জামাই যেন বোকা বনে যায়। আর নিখুঁতভাবে সেই দায়িত্ত্ব পালনে ডাক পড়লো ময়রা সূর্যকুমার মোদকের। কিছুটা জমিদার গিন্নির বুদ্ধিতে আর সারা রাত ময়রার খাটানিতে অবশেষে তৈরী হয় ‘জামাই ঠকানো মিষ্টি’। এই মিষ্টি কিন্তু বানানো একেবারেই সহজ নয়। সারা রাত ভেবে মোদক মশাই ছুতোরকে দিয়ে বানান ছাঁচ। এই মিষ্টির মূল উপাদান ছিল ছানা ও নলেন গুড় আর গোলাপজল। শোনা যায় সেই গোলাপজল নাকি কনৌজ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। প্রথমে ছাঁচের মধ্যে কিছুটা সন্দেশ দিয়ে তারপর আঙুলের চাপে গর্ত করে নিয়ে সেই গর্তে চামচে করে দেওয়া হয় গোলাপজল। এর পর আবার সন্দেশ দিয়ে বাকিটা সিল করে ছাঁচের মুখ বন্ধ করে দিয়ে তৈরী করা হয় জলভরা তালশাঁস সন্দেশ। বর্তমানে সূর্যকুমার মোদকের পঞ্চম প্রজন্ম সেই ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছে।
মতিচুর সন্দেশ :
মতিচুর সন্দেশের সঙ্গে বিশেষ যোগ রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Rabindranath Tagore)। হুগলি জেলার চন্দননগরে তিনি ছিলেন বেশ অনেকদিনই। সেখানেই এসে এই মিষ্টি খান কবিগুরু। এমনকি এই মিষ্টির নামকরণও করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জানা যায়, চন্দননগরের সূর্য মোদকের মিষ্টি ছিল রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয়। এই সন্দেশ হাতে নিলেই তা মুক্তর মতো চূর্ণ হয়ে যায়। সেই থেকেই তিনি এই সন্দেশের নাম দিয়েছিলেন মতিচুর সন্দেশ। অতীতের সময় থেকেই এখনও পর্যন্ত ইতিহাস বহন করে নিয়ে আসছে চন্দননগরের সূর্য মোদকের এই মতিচুর সন্দেশ। পাঁচটি প্রজন্ম পেরিয়ে দোকানের বর্তমান প্রজন্ম এখনও পর্যন্ত ধরে রেখেছে সেই মিষ্টির ঐতিহ্য। সেই আগের প্রথা মেনেই এখনও দুধ ক্ষীর দিয়ে তৈরি করা হয় এই মতিচুর সন্দেশ।
গুপো সন্দেশ :
জলভরা সন্দেশের আগেও পশ্চিমবঙ্গের জিআই ট্যাগ (Gi Tag of West Bengal) পাওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে হুগলির আরেক বিখ্যাত মিষ্টি গুপো সন্দেশের জন্যও। রসগোল্লার পর এবার জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেল হুগলির গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত গুপো সন্দেশ। বিখ্যাত এই গুপো সন্দেশের জন্ম কত সালে হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও এই সন্দেশের উৎপত্তি গুপ্তিপাড়ায়। হাওড়া-কাটোয়া শাখায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই প্রাচীন জনপদ গুপ্তিপাড়া আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এই বিশেষ ধরনের সন্দেশ বানানোর পদ্ধতিও অভিনব। প্রথমে বিশাল আকারের লোহার কড়াইতে ছানাকে পাক দেওয়া হয়। তারপর সেই পাক দেওয়া ছানা পরিষ্কার কাপড়ে বেঁধে কাঠ দিয়ে পেটানো হয় যাতে ওই ছানার ভিতরের অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যায়। তারপর সেই ছানা একত্রিত করে পাক দিয়ে তাকে গুপো সন্দেশের আকার দেওয়া হয়। শীতকালে এই সন্দেশে নতুন গুড় মিশিয়ে তার স্বাদে বদল ঘটানো হত। পূর্বে বহু অনুষ্ঠানবাড়িতে এই সন্দেশ দিয়ে অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করা হত। সন্দেশের স্বাদে অভিনবত্ব আনার জন্য মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা সারা বছর ধরে খেজুরের গুড় জমা করে রাখতেন। বর্তমানে গুপ্তিপাড়ায় গুটিকয়েক মিষ্টির দোকানে এই সন্দেশ পাওয়া গেলেও সেটির স্বাদ পেতে বিশ্বের কোণা কোণা থেকে ছুঁটে আসেন মিষ্টি প্রেমীরা।
মনোহরা :
মনোহরা পশ্চিমবঙ্গের এক অতি জনপ্রিয় মিষ্টি। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার জনাইয়ের ও মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙার মনোহরা অতি প্রসিদ্ধ। একে অনেক জায়গায় চাউনি সন্দেশও বলা হয়। মনোহরা মিষ্টি হল ছানা ও চিনির অথবা সরচাঁছি ও ক্ষীরের মিশ্রণের গোল্লার উপর চিনির স্তর দেওয়া একটি গোলকাকৃতি মিষ্টি। সাম্প্রতিক কালে কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক গিরীশচন্দ্র দে ও নকুড়চন্দ্র নন্দী চিনির বদলে নলেন গুড়ের প্রলেপ দেওয়া মনোহরার প্রচলন করেন।
সাদা বোঁদে :
কামারপুকুরের সাদা বোঁদে পশ্চিমবঙ্গের স্বতন্ত্র ও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অত্যন্ত প্রিয় ছিল এই মিষ্টান্ন। তবে প্রচলিত বোঁদের সঙ্গে এই বোঁদের পার্থক্য রয়েছে। কামারপুকুরের সাদা বোঁদের প্রধান উপাদান রমা কলাইয়ের বেসন ও আতপ চালের গুঁড়ো। তার সঙ্গে লাগে গাওয়া ঘি বা বনস্পতি ও চিনির রস। রমা কলাই বা রম্ভা কলাই বলতে বরবটির বীজকে বোঝানো হয়। সেই জন্য রমা কলাইয়ের বেসনকে বরবটির বেসনও বলে। অতীতে কামারপুকুরের স্থানীয় চাষীরাই বরবটি চাষ করে পাকা বরবটির বীজের জোগান দিতেন। সেই বরবটির বীজ অর্থাৎ রমা কলাইকে প্রথমে জলে ধুয়ে তারপর রোদে শুকিয়ে নেওয়া হত। এর পর সেই শুকনো কলাইকে পিষে বেসন তৈরি করা হত। অতীতে সাদা বোঁদে ভাজা হত গাওয়া ঘিতে। কিন্তু খরচে পোষাতে না পেরে অধিকাংশ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী বনস্পতি ঘি বা ডালডা ব্যবহার করেন।
প্রসঙ্গত, বাঙালির মিষ্টির প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। অনেক বিদেশী-বিদেশিনী বা অন্য ভাষাভাষীর মানুষ বলে থাকেন, বাঙালি এতো মিষ্টি খেতে পছন্দ করে বলেই বাঙালির কথার মধ্যেও রয়েছে মিষ্টিভাব। শুভ কাজ হোক কিংবা খাবার শেষে মিষ্টিমুখ। বাঙালির প্রত্যেক অনুষ্ঠানেই বিশেষ জায়গা করে নেয় মিষ্টি। তবে বাঙালির প্রিয় খাবার হওয়ার পাশাপাশি বাংলার অন্যতম ব্যবসা হিসাবেও এগিয়ে মিষ্টি ব্যবসা। পশ্চিমবঙ্গে ১০০,০০ টিরও বেশি মিষ্টির দোকান রয়েছে, যা সম্মিলিতভাবে প্রতিদিন ৫০ মিলিয়ন লিটার দুধ ব্যবহার করে এবং প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। এর সব থেকে ভালো উদাহরণ সম্পর্কে কথা বলতে গেলেও সেই প্রসঙ্গ টানতে হয় হুগলির। কারণ সেখানেই অবস্থিত একটা গোটা গ্রাম, যার নামকরণ এক ধরণের মিষ্টির নামে। এই গ্রামের নাম রাবড়ি! হুগলি জেলার এই অদ্ভুত ছোট্ট গ্রাম রাবড়ি। এই গ্রামের নাম রাবড়ি দেওয়ার হয় মিষ্টি তৈরির ব্যবসা রাজ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হওয়ার পরে। এর ফলে এর অর্ধেকেরও বেশি বাসিন্দা রাবড়ি তৈরি ও বিক্রির কাজে নিয়োজিত হয়। মূলত চণ্ডীতলা আনিয়া গ্রাম নামে পরিচিত, এই স্থানের প্রায় প্রত্যেক গ্রামবাসীর আয়ের প্রধান উৎস মিষ্টি তৈরি। এই মিষ্টির ইতিহাস ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চণ্ডীমঙ্গলা থেকে পাওয়া যায়। জানা গেছে, এই গ্রামের প্রতিটি ব্যবসায়ী শত শত লিটার দুধ নিয়ে কাজ করেন।