ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের জীবনী, Biography of Language Martyr Shafiur Rahman in Bengali

Friday, July 8 2022, 2:06 pm
highlightKey Highlights

শফিউর রহমান ছিলেন ১৯৫২ সালের ভাষা শহীদ যিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতির দাবিতে ১৯৫২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিক্ষোভ চলাকালীন সময়ে নিহত হন।


জন্ম ও পরিবার , Birth and Family 

শফিউর রহমানের জন্ম  
শফিউর রহমানের জন্ম  

ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের জন্ম হয় ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারিতে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের অধীনস্থ পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুর জনপদের অন্তর্ভুক্ত কোন্নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতার নাম হাকিম মাহবুবুর রহমান, তিনি পেশায় ছিলেন ঢাকার পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ অফিসের সুপারিনটেনডেন্ট; এবং তাঁর মাতার নাম ছিল কানেতাতুন নেসা। শফিউর রহমানরা পাঁচ ভাই ও দুই বোন ছিলেন। তিনি ছিলেন সকলের মধ্যে জেষ্ঠ। 

ভাষাশহীদ শফিউর রহমান
ভাষাশহীদ শফিউর রহমান

শিক্ষা অর্জন, Education 

শহীদ শফিউর রহমান ১৯৩৬ সালে তাঁর গ্রামের অন্তর্ভুক্ত কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার সরকারি কমার্স কলেজে ভর্তি হন এবং সেখানে আই.কম বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। দারিদ্রতার কারণে পড়াশোনায় আর এগিয়ে যেতে পারেন নি তিনি, তাই সংসারে টানাপোড়ন সামলে নিতে চাকরির সন্ধান শুরু করেন।

কর্মজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, Career Experiences

আই.কম - এর পড়াশুনা শেষ করে শফিউর রহমান পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা সিভিল সাপ্লাই অফিসে কেরানীর চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কিছু সময় পর, ১৯৪৮ সালে তিনি কলকাতা থেকে পিতার সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। অতঃপর শফিউর ঢাকা হাইকোর্টে হিসাব রক্ষণ শাখায় কেরানীর চাকরির পদে কাজ শুরু করেন।

কর্মজীবন  
কর্মজীবন  

ব্যক্তিগত জীবন বৃত্তান্ত, Personal Life 

শফিউর রহমান ১৯৪৫ সালের ২৮ মে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন; তখন তাঁর বয়স ছিল ২৭ বছর। বৈবাহিক জীবনে দাম্পত্য সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন কলকাতার তমিজউদ্দিনের কন্যা আকিলা খাতুনকে। বিবাহকালে আকিলা খাতুনের বয়স ছিল ১২ বছর। এই দম্পতির ঘরে পরবর্তী সময়ে একটি কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়; মেয়ে শাহনাজ এবং ছেলে শফিকুর রহমান। 

ব্যক্তিগত জীবন  
ব্যক্তিগত জীবন  

বাংলা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ, Participation in the Bengali language movement

ভাষা আন্দোলন  
ভাষা আন্দোলন  

বাঙালিদের সাংস্কৃতিক জীবনের ইতিহাসে বাংলা ভাষা আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যার তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব আজও বিদ্যমান। সকল বাঙালির মধ্যে বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপলক্ষ উদ্‌যাপন এবং ভাষার উন্নয়ন বিষয়ে কাজ করার মানসিকতা তৈরির ক্ষেত্রে এই আন্দোলনের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।

উল্লেখ্য বাংলার ভাষা আন্দোলন ১৯৪৭ সাল থেকে দীর্ঘ ১৯৫৬ সাল অবধি চলেছিল। ১৯৫২‌ সালের প্রথমদিকে ভাষা আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি নিয়ে জনগন বিক্ষোভ করতে শুরু করে।  ‘রাষ্ট্র ভাষা, বাংলা চাই’ শ্লোগানে ঢাকার অলি - গলি তখন প্রকম্পিত। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে বেশ কিছু ছাত্র ও স্থানীয় বিদ্রোহী জনতা মিলে আন্দোলন করে।

এই বিক্ষোভ আন্দোলন ঠেকানোর চেষ্টায় তৎকালীন সরকার ১৪৪ ধারা বলবৎ রেখেছিল; কিন্তু সেসব উপেক্ষা করে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেল এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে । এই বিক্ষোভকারীদের বাধা দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকার সেই মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে, ফলে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

উক্ত ঘটনার পরের দিন, অর্থাৎ ২২ শে ফেব্রুয়ারি সকাল দশটার দিকে শফিউর রহমান ঢাকার রঘুনাথ দাস লেন স্থিত বাড়ি থেকে সাইকেলে করে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হন । সকাল সাড়ে দশটার দিকে নওয়াবপুর রোডে পূর্বদিনে ভাষা আন্দোলনের বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ফের ছাত্র-জনতা মিলিত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। পুলিশ পুনরায় তাদের উপর এলোপাথারী গুলিবর্ষণ করে।

দুর্ভাগ্যক্রমে পুলিশের একটি গুলি শফিউর রহমানের পিঠে এসে লাগে। ১৯৫৪ সালের শহীদ সংখ্যা সাপ্তাহিক দৈনিকে তাঁর সম্পর্কে প্রকাশিত বিবরণে বলা হয় যে, সেই দিন সকাল ১০ টায় শফিউর সাইকেলে চড়ে নবাবপুর রোড হয়ে অফিসে যাওয়ার পথে হঠাৎ একটি রাইফেলের গুলি তাঁর পৃষ্ঠভেদ করে বের হয়ে যায় এবং এতে তিনি তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

সরকারি এ্যাম্বুলেন্সের সহায়তায় তাঁকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। 

শফিউর রহমানের  রক্তাক্ত পরিধান  
শফিউর রহমানের  রক্তাক্ত পরিধান  

মৃত্যু, Death 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. এ্যালিনসন গুলিবিদ্ধ শফিউর রহমানের অপারেশন করেছিলেন; কিন্তু তাঁর অস্ত্রোপচার সফল হয়নি এবং প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হওয়ার ফলে ২২ শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা নাগাদ তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পুলিশের গুলিতে শহীদ শফিউর রহমানের কলিজা ছিঁড়ে গিয়েছিল।

অপারেশনের সময় সফিউরের মাতা, পিতা, স্ত্রী ও মেয়ে শাহনাজ সকলেই হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন। ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের মৃত্যুর পর পুলিশ তাঁর মরদেহ আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করেনি। ২২ শে ফেব্রুয়ারী রাত ৩ টায় পুলিশ প্রহরায় আজিমপুর গোরস্থানে তাঁকে কবরস্থ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৫২ সালের ১৪ই মার্চ তারিখে দৈনিক আজাদে প্রকাশিত সরকারি তথ্য বিবরণী থেকে জানা যায় যে, কবর দেওয়ার আগে তৎকালীন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর জানাজা পড়ান।

জানাজায় শহীদের পিতা ও ভাই উপস্থিত ছিলেন। উক্ত ঘটনার দুই দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শফিউর রহমানের বাবা হাকিম মাহবুবুর রহমান প্রথম শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। শফিউর রহমানের মৃত্যুর তিন মাস পর তাঁর পুত্রসন্তান শফিকুর রহমানের জন্ম হয়। 

মরণোত্তর একুশে পদক প্রাপ্তি, Received  Ekushey Padak

একুশে পদক বাংলাদেশের একটি জাতীয় এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। ১৯৭৬ সালে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে এই পদকের প্রচলন করা হয়; বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান একুশে পদক প্রবর্তন করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি প্রদানের উদ্দেশ্যে ২০০০ সাল থেকে ভাষাশহীদ সহ আরো অনেক বিশেষ ব্যক্তিকেই একুশে পদক প্রদান করা হয়েছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভাষাশহীদ শফিউর রহমানকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।

এছাড়া ২০০৬ সালে ভাষা আন্দোলনে মৃত্যুবরণকারী অন্যান্য পরিবারের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী বেগম আকিলা খাতুনকেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আজীবন ভাতা প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয় । শহীদ শফিউর রহমানের রক্তমাখা শার্ট, কোট ও জুতা সংরক্ষণ করা হয়েছিল, যা বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

উপসংহার, Conclusion 

ইতিহাসের যে ক'জন দেশপ্রেমিকদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে মাতৃভাষা বাংলা, ‘শফিউর রহমান’ - এর নাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সরকারি চাকুরিজীবি হওয়ার কারণে শফিউর কোন প্রতিবাদ সভা তথা সমাবেশে অংশ নিতে না পারলেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়মিত আলোচনা করতেন তিনি ।

দেশের জন্য, দেশের জনগণের জন্য এবং বাংলা ভাষার জন্য কল্যাণকর কিছু কাজ করার তীব্র তাগিদ সর্বক্ষণ অনুভব করতেন তিনি। মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে শফিউর রহমান না ফেরার দেশে চলে যান। তাঁর আত্মবলিদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলার জনগন আজীবন তাঁকে ভাষাশহীদ হিসেবে স্মরণ করবে।

Frequently Asked Questions 


প্রশ্নোত্তর - Frequently Asked Questions

শফিউর রহমান কে ছিলেন?

শফিউর রহমান ছিলেন বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের শহীদ।

শফিউর রহমানের জন্ম কবে হয়?

১৯১৮ সালে।

শফিউর রহমানের মৃত্যু কবে ঘটে?

১৯৫২ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি।

শফিউর রহমানকে কোথায় সমাধিস্থ করা হয় ?

আজিমপুর গোরস্থানে।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File