Bhoot Chaturdashi 2024 । ১৪ শাক কি আসলে ভূতেদের ‘আণ্টিডোড’ ? কোন শাকের কী গুনাগুন? জানুন বিস্তারিতভাবে
কালীপুজোর ঠিক আগে, ভুত চতুর্দশীর দিন বাঙালি বাড়িতে ১৪ শাক খাওয়ার প্রথা রয়েছে। কিন্তু,কেন সুপ্রাচীন কাল থেকে এই প্রথা পালিত হচ্ছে? এর নেপথ্যে রয়েছে বিজ্ঞান! আশ্বিন ও কার্তিক মাসকে ‘যমদষ্টা কাল’ বলা হয়। এই সময় শীতের মরসুম শুরু হয়। মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই রোগভোগ থেকে আগাম সুরক্ষা পেতে এই ১৪ শাক খাওয়া হয়। এই শাকগুলি হলো ওল, কেঁউ, বেতো/বেথুয়া,কালকাসুন্দে,সর্ষে,নিম,জয়ন্তী, শালিঞ্চ/শিঞ্চে, গুড়ুচি, পটলপত্র, শেলুকা, হেলেঞ্চা/হিঞ্চে, ঘেঁটু/ঘণ্টাকর্ণ, শুষনি।
কালীপুজোর ঠিক আগে, অর্থাৎ, ভুত চতুর্দশীর দিন বাঙালি বাড়িতে ১৪ শাক খাওয়ার প্রথা রয়েছে। কিন্তু, কেন সুপ্রাচীন কাল থেকে এই প্রথা পালিত হচ্ছে জানেন? এর পিছনে কি রয়েছে শুধুই শাস্ত্রের বিধান? নাকি অন্য কোনও রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই প্রথা গহ্বরে। চলুন জেনে নেওয়া যাক কেন ভূত চতুর্দশীর দিন চোদ্দ শাক খাওয়ার প্রথা রয়েছে এবং এই চোদ্দটি শাকের উপকারিতাই বা কী কী-
ভূত চতুর্দশীর দিন ১৪ শাক খাওয়ার কারণ :
ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, প্রতি বছর আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষে পালিত হয় চতুর্দশী তিথি। এদিন ১৪ শাক খেয়ে ১৪জন পূর্বপুরুষকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এই চোদ্দটি শাক হলো ওল, কেঁউ, বেতো বা বেথুয়া, কালকাসুন্দে, সর্ষে,নিম, জয়ন্তী, শালিঞ্চ বা শিঞ্চে, গুড়ুচি, পটলপত্র, শেলুকা, হেলেঞ্চা বা হিঞ্চে, ঘেঁটু/ঘণ্টাকর্ণ,শুষনি। প্রচলিত প্রথার পাশাপাশি এই সময় শাক খাওয়ার পেছনে একটি বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে। আশ্বিন ও কার্তিক মাসকে ‘যমদষ্টা কাল’ বলা হয়। এই সময় শীতের মরসুম শুরু হয়, ফলে মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই রোগভোগ থেকে আগাম সুরক্ষা পেতে এই ১৪ শাক ভক্ষণের প্রথা আছে।
কোন শাকের কী গুনাগুন ?
চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা, অষ্টাঙ্গ হৃদয়-সহ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের বিভিন্ন গ্রন্থে ১৪ শাকের উল্ল্যেখ আছে। এই রীতি স্বাস্থ্যসম্মতও। রঘুনন্দন, ষোড়শ শতাব্দীতে তাঁর প্রাচীন স্মৃতির গ্রন্থ ‘নির্ণয়ামৃত’-র অভিমত অণুসরণ করে এই ১৪ প্রকার শাকের গুনাগুন বর্ণনা করেছেন। এই চোদ্দটি শাক হলো ওল, কেঁউ, বেতো বা বেথুয়া, কালকাসুন্দে, সর্ষে,নিম, জয়ন্তী, শালিঞ্চ বা শিঞ্চে, গুড়ুচি, পটলপত্র, শেলুকা, হেলেঞ্চা বা হিঞ্চে, ঘেঁটু/ঘণ্টাকর্ণ,শুষনি। এই ১৪ রকম শাকে রয়েছে নানা রোগের সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষমতা। আসুন জানা যাক, কোন শাকের কী গুন:
ওল: ওলের কন্দ/ মূল অর্শ, প্লীহা বৃদ্ধির রোগ এবং রক্ত আমাশার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
কেঁউ: কেঁউ পাতার রস হজমে সাহায্য করে, খিদে বাড়ায়। জ্বর, আমাশা, ডায়েরিয়া, কফ, কাটা-ছেঁড়া, ক্ষত, চর্মরোগ, আরথ্রাইটিস, কোষ্ঠকাঠিন্য, কুষ্ঠ, কৃমি, চুলকানি, ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
বেতো /বেথুয়া: কোষ্ঠবদ্ধতা, রক্তাল্পতা, অম্বল, কৃমি, মুখে ঘা, ত্বকের রোগ, বাত ও অর্শ প্রতিরোধে বেথুয়া শাক খুব উপকারী। কারণ, এই শাকে প্রচুর ভিটামিন এ , ভিটামিন সি, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস ও জিঙ্ক এবং গুরুত্বপূর্ণ ৮ টি অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে।
কালকাসুন্দে: এই শাকের রস অ্যালার্জি, জ্বর, ক্ষত নিরাময় ও কোষ্ঠবদ্ধতা দূর করে।
সর্ষে: এই শাকে বহুল পরিমানে ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও লোহা থাকে যা শরীরের স্বাভাবিক যৌগের চাহিদা মেটায়। ভিটামিন কে, ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই সমৃদ্ধ এই শাকের স্বাদ খুব ভালো।
নিম: দীর্ঘদিন জীবিত থাকা এই গাছটির পাতার গুণ প্রচুর। চর্মরোগ, কুষ্ঠ ও সুগার রোগীদের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বহুল প্রচলিত। এছাড়া এই পাতার রস বহুমূত্র রোগের অন্যতম ঔষধ।
জয়ন্তী: জয়ন্তী শাকের প্রচুর গুনাগুন। বহুমূত্র, কৃমিনাশ এবং শ্বেতির মতো রোগের চিকিৎসাতে ব্যবহার হয় এই শাক।
শালিঞ্চ/ শিঞ্চে: এই শাকের আরেক নাম সাঁচিশাক। চোখ, চুল ও ত্বকের যত্নে শালিঞ্চা শাক ভীষণ উপকারী। ডায়েরিয়া, অজীর্ণ চিকিৎসায় এই শাক খেলে উপকার হয়। এই শাকোর্ট রস খেলে মায়ের স্তনদুগ্ধের পরিমাণ বাড়ে।
গুড়ুচি/গুলঞ্চ: ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা, কোষ্ঠকাঠিন্য, বাত, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, হেপাটাইটিস, পেপটিক আলসার, গনোরিয়া, সিফিলিস, শোথ, জ্বর ইত্যদি রোগের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় গুলঞ্চ ব্যবহৃত হয়। গুলঞ্চ শাক খেলে ইমিউনিটি বাড়ে।
পটলপত্র: রক্ত শোধন করতে এবং রক্ত বাড়াতে পটলপাতার রস ভীষণ উপকারী। লিভার ও চর্মরোগ সারাতেও পটলপাতা খুব কার্যকর। ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে এই পাতার রস ব্যবহৃত হয়। এই পাতা কোষ্ঠকাঠিন্য সারায়, খিদে ও হজমশক্তি বাড়ায়। ক্ষতস্থানে পটলপাতার রস লাগালে ক্ষতস্থান তাড়াতড়ি শুকায়।
শেলুকা: সংস্কৃতে শেলুকা বা শুলফাকে বলে 'শতপুষ্প'। এই ভেষজ উদ্ভিদের কাঁচা পাতা ও বীজ মশলা হিসাবে রান্নায় ব্যবহৃত হয়। শাক হিসাবে ব্যবহৃত হয় পাতাসহ ডগা। মাতৃদুগ্ধের পরিমাণ বাড়াতে ও বাচ্চাদের পেটের রোগ সারাতে শুলফা শাক খুব উপকারী। চোখের রোগ, চোখে ঘা, পুরানো ক্ষত, জ্বর, ইত্যদি রোগের নিরাময়ে শুলফা উপকারী।
হেলেঞ্চা / হিঞ্চে : হেলেঞ্চাকে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে রক্তশোধক, পিত্তনাশক, ক্ষুধাবর্ধক নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই শাক নিয়মিত খেলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ে। হেলেঞ্চা শাকে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকে যা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। মাথার যন্ত্রণায় এই শাক বেটে লাগালে যন্ত্রণা কমে। নিয়মিত খেলে কমে ব্লাড সুগারও।
ঘেঁটু/ঘণ্টাকর্ণ: এই পাতাতে প্রচুর পরিমানে 'ফ্ল্যাভোনয়েড' নামক যৌগ থাকে, যা শরীরে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট বাড়ায় । চুল পড়া, হাঁপানি, কফ, বাত, জ্বর, চর্মরোগ, লিভারের রোগ, ইত্যদি রোগ প্রতিরোধে ঘেঁটু পাতা খুব কার্যকরী। ঘেঁটু পাতা বেটে ঘা বা ফোলা জায়গার ওপর লাগালে ক্ষত তাড়াতাড়ি সারে।
শুষনি: শুষনির বিজ্ঞানসম্মত নাম 'মার্সিলি কোয়াড্রিফোলিয়া' বা 'মার্সিলি মিনুটা'। ভারতসহ দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়া, চিন, মধ্য ও দক্ষিণ ইউরোপে ভেষজ উদ্ভিদ হিসাবে শুষনি খুব পরিচিত। শুষনি পাতা নিদ্রাহীনতা রোগের অব্যর্থ ওষুধ।
বাঙালির হেঁশেলে বহুকাল ধরেই এইসব শাক নিজেদের পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সব জেলাতেই এই শাকগুলি কমবেশি জন্মায় এই সময়। ভুত চতুর্দশীতে ১৪ জন পূর্বপুরুষের মুক্তিকামনায় ১৪শাক খাওয়ার প্রচলন থাকলেও, এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। ডাক্তারদের মতে, হেমন্তের শেষে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমান কমতে থাকে, ফলে ত্বক শুস্ক হতে শুরু করে। দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও কমতে শুরু করে। এসময় মরসুমি শাকপাতা খেলে রোগভোগে পড়ার সম্ভাবনা কমে যায় অনেকখানি।তাই, শীতের শুরুতে শরীর সুস্থ রাখতে নিয়মিত পাতে রাখুন এই সমস্ত শাকগুলি। রোগমুক্ত হবে শরীর, প্রাচুর্য আসবে জীবনেও।