Titan Submarine | আটলান্টিকের নীচে ধ্বংস 'টাইটান'! বেঁচে আছেন যাত্রীরা? কীভাবেই বা হলো দুর্ঘটনা?
টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে ৫ যাত্রীকে নিয়ে পারি দেয় 'টাইটান'। দীর্ঘদিন পর খোঁজ মেলে খুদে সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষের। টাইটানের যাত্রীর সঙ্গে যোগ 'টাইটানিকে'র।
টাইটানিকের (Titanic) ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া খুদে সাবমেরিনও (Submarine) পরিণত হল ধ্বংসাবশেষে। ১১১ বছর আগে আটলান্টিক মহাসাগরের দৈত্যাকার হিমশৈলেতে ধাক্কা খেয়ে চিরতরে তলিয়ে গিয়েছিলো টাইটানিক জাহাজ। সেই জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতেই ৫ জন যাত্রীকে নিয়ে পারি দিয়েছিলো টাইটান (Titan)। তবে টাইটানিকের মতো এই সাবমেরিনও আটলান্টিকের (Atlantic) গভীরেই তলিয়ে গেলো। যাত্রীদের আর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বলেই জানায় পর্যটন সংস্থা ওশানগেট (Oceangate)।
গত রবিবার পাঁচ যাত্রীকে নিয়ে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য রওনা দিয়েছিল টাইটান সাবমেরিন। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ থেকে ৬০০ কিমি দূরে অবস্থিত কানাডার পূর্বে নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলে (Coast of Newfoundland, East of Canada) থেকে সূচনা হয় এই যাত্রার। তবে 'মাদারশিপ' থেকে টাইটান বিচ্ছিন্ন হয়ে সমুদ্রে ডুব দেওয়ার ঘন্টা দুয়েক পরেই ই 'মাদারশিপ'-এর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় টাইটানের। রিপোর্ট অনুযায়ী, স্থানীয় সময়ে রবিবার সকাল ৯টা ৪৫ মিনিট নাগাদ টাইটানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় মাদারশিপের। এরপরই ওই খুদে সাবমেরিনকে উদ্ধার করার জন্য বিকেল ৫টা ৪০ মিনিট নাগাদ আমেরিকার উপকূলরক্ষী বাহিনীকে (US Coast Guard) খবর দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে টাইটানের সন্ধান চালানোর পরেও খোঁজ মেলে না ওই সাবমেরিনের। ক্রমশ বাড়তে থাকে আশঙ্কা।
টাইটান সাবমেরিনের উদ্ধারকার্য । Rescue Work of the Titan Submarine :
সূত্রের খবর, টাইটানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পরেই সন্ধানকার্যে নামে আমেরিকার উপকূলরক্ষী বাহিনী। এই উদ্ধারকাজে যোগ দিয়েছিল ফ্রান্স (France) এবং ব্রিটেনও (Britain)। উদ্ধারকাজের জন্য গভীর সমুদ্রে সচল থাকবে এমন রোবটও (Robot) পাঠানো হয় ফ্রান্সের তরফ থেকে। পাশাপাশি ব্রিটেন ওই হারিয়ে যাওয়া ডুবোজাহাজটি খুঁজে বের করার জন্য একটি সাবমেরিনার পাঠায়। কিন্তু তাতেও প্রাণের খোঁজ পাওয়া গেল না। অবশেষে খুদে সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষের খোঁজ মেলে তিন-চার দিন পর। আমেরিকার উপকূলরক্ষা বাহিনীর রিয়ার অ্যাডমিরাল জন মউগার জানান (US Coast Guard Rear Admiral John Mauger), টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের ১৬০০ ফুট দূরেই পাওয়া গিয়েছে টাইটান সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষ। জানা গিয়েছে, ৯৬ ঘণ্টার অক্সিজেন নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল টাইটান। যা বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
দীর্ঘ সন্ধানকার্য চালানোর পর মার্কিন সময়ে, বৃহস্পতিবার দুপুর নাগাদ পাওয়া যায় টাইটান সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষ। বৃহস্পতিবার সাংবাদিক সম্মেলন করে মার্কিন নৌসেনা জানায়, টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের খুব কাছেই ভেঙে পড়েছে সাবমেরিন টাইটান। সমুদ্রের প্রায় ১২ হাজার ফুট গভীরে সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পায় রোবট। ধ্বংসাবশেষ দেখে সাবমেরিনে থাকা পাঁচ যাত্রীর কোনও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বলেই জানায় মার্কিন নৌসেনা। ফলে উদ্ধারকারীদের অধিকাংশকেই সরিয়ে নেওয়া হবে। তবে জলের তলায় কীভাবে সাবমেরিনটি ভেঙে পড়ে এবং কীভাবেই বা যাত্রীদের মৃত্যু হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত চলবে।
উল্লেখ্য,রবিবার পাঁচ অভিযাত্রীকে নিয়ে জলের তলায় ডুব দেওয়ার পর সাত ঘণ্টার মধ্যেই জলের তলদেশ থেকে ফিরে আসার কথা ছিল টাইটানের। কিন্তু জলে ডোবার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই সাবমেরিনের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এদিকে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে জানা সত্ত্বেও রায় আট ঘণ্টা পরে উদ্ধারকাজ শুরু করে মার্কিন নৌবাহিনী। ফলে কেন এতো দেরিতে উদ্ধারকার্য শুরু হয় সেই নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
কীভাবে ধ্বংস হয় টাইটান সাবমেরিন? । How Titan Submarine Destroyed?
ঠিক কীভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয় খুদে সাবমেরিন টাইটান, সেই সম্পর্কে এখনও স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি। তবে মার্কিন উপকূলরক্ষা বাহিনীর তরফে জানানো হয়েছে, ভিতরের দিকে দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিলো টাইটান। এই দুর্ঘটনার জেরেই মৃত্যু হয়েছে ৫ যাত্রীর। প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, জলের গভীরে যেতেই জলের চাপে দুমড়েমুচড়ে যায় টাইটান। অন্যদিকে ওসেনগেটের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, টাইটান সাবমেরিন ৪০০০ মিটার বা ১৩ হাজার ১২০ ফুট গভীর পর্যন্ত যেতে পারে। কিন্তু টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৮০০ মিটার বা ১২ হাজার ৪০০ ফুট গভীরে। এদিকে সেই গভীরতায় জলের চাপ থাকে ৬০০০ পাউন্ড প্রতি ইঞ্চি। যা একটা বড় হাঙরের কামরের থেকেও দেড় গুণ শক্তিশালী।
মার্কিন নৌবাহিনী সূত্রে খবর, যেই সময় মাদারশিপের সঙ্গে টাইটানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়, সেই সময়ই তারা একটি জলযানের দুমড়েমুচড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়েছিল। ফলে মনে করা হচ্ছে, ডুবোযানটির কোথাও কোনও ধরনের ছিদ্র বা চিড় থাকলে তা ওই গভীরতায় জলের চাপে সাবমেরিনটি ধ্বংস করে দেওয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ওই গভীরতায় জলের চাপে সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মৃত্যু অনিবার্য।
টাইটানে যাত্রী হিসেবে কারা ছিলেন? । Who Were The Passengers on the Titan?
৬.৭ মিটার লম্বা এই ডুবোযানটির উদ্দেশ্য ছিল রবিবার জলের নিচে নেমে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখে ৭ ঘন্টার মধ্যে জলস্তরের ওপরে উঠে আসা। তবে 'মাদারশিপ' থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পরই আটলান্টিক মহাসাগরে নিখোঁজ হয়ে যায় সাবমেরিনটি। পরে বৃহস্পতিবার সন্ধান পাওয়া যায় টাইটানের ধ্বংসাবশেষের। প্রাথমিক ধারণা থেকে অনুমান, জলে ডুব দিতেই গভীর জলের চাপে দুমড়েমুচড়ে যায় সাবমেরিনটি। মৃত্যু হয়েছে যাত্রীদেরও। টাইটানের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেলেও তা এখন উদ্ধার করা যাবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে বড় প্রশ্ন। পাশাপাশি যাত্রীদের মৃতদেহও উদ্ধার করা যাবে না বলেই আশঙ্কা।
টাইটানে চেপে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়েছিলেন,ব্রিটেনের ব্যবসায়ী হ্যামিশ হার্ডিং (Hamish Harding), পাকিস্তানের ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ (Shahzada Dawood) ও তাঁর পুত্র সুলেমান (Suleiman), ওসেনগেট সংস্থার মুখ্য আধিকারিক স্টকটন রাশ (Stockton Rush) এবং ফরাসি নাবিক পল হেনরি নারজিওলেট (Paul Henri Nargeolet)। প্রত্যেকেই টাইটানে করে করে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়ার জন্য মাথাপিছু আড়াই লক্ষ ডলার করে দিয়েছিলেন ওসেনগেট সংস্থাকে।
টাইটানিকের সঙ্গে টাইটানের যোগ । The Connection Between Titanic and Titan :
১৯১২ সালে আটলান্টিক মহাসাগরের অতলে তলিয়ে গিয়েছিল বিলাসবহুল জাহাজ ‘টাইটানিক’। এই দুর্ঘটনার নিখুঁত বিবরণ দিয়ে সিনেমা তৈরী করে গোটা বিশ্বকে টাইটানিকের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তির পরিচয় জানিয়েছিলেন পরিচালক জেমস ক্যামেরন (James Cameron)। 'টাইটানিক' সিনেমা থেকেই জ্যাক-রোজের প্রেম কাহিনী হয়ে ওঠে অমর। এই যুগলের মতোই আরো এক সত্যিকারের ভালোবাসার গল্প উঠে এসেছিলো এক বৃদ্ধ দম্পতি দ্বারা। টাইটানিক যখন ডুবছে তখন লাইফ জ্যাকেট খুলে ফেলে পরস্পর পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে একসঙ্গে বিছানায় শুয়ে শান্তভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন ইডিটর স্ট্রস (Editors Straus) ও ইডা স্ট্রস (Ida Straus)। টাইটানিকের অতলান্তের সঙ্গেই হিমশীতল আটলান্টিক মহাসাগরের জলে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁদের। এরপর ১১১ বছর পর টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া টাইটানও আটলান্টিক মহাসাগরের জলেই হারিয়ে যায়। তবে এই ঘটনায় টাইটানিকের সঙ্গে টাইটানের রয়েছে আরও ভাগ্যের মিল। টাইটানিকের ঘটনায় মৃত স্ট্রস দম্পতির প্রপৌত্রী ছিলেন টাইটানে। যার মৃত্যু হয় সেই একই মহাসাগরে, একই যোগসূত্রে।
জানা গিয়েছে, টাইটানের যাত্রী ওয়েন্ডি রাশ হলেন স্ট্রস দম্পতির প্রপৌত্রী। ওসিয়ান গেট-এর সিইও স্টকটোন রাশ হলেন স্ট্রস দম্পতির প্রপৌত্রী ওয়েন্ডি রাশের স্বামী। নিউ ইয়র্ক টাইমস সূত্রে জানা গিয়েছে, স্ট্রস দম্পতির একমাত্র মেয়ে মিনি। তিনি ১৯০৫ সালে ডা. রিচার্ড উইলকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের পুত্র জুনিয়ার উইল নিউ ইয়র্কের মেসির প্রেসিডেন্ট হন। তাঁর পুত্র তৃতীয় রিচার্ড উইল পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। তাঁরই মেয়ে হলেন ওয়েন্ডি রাশ। যিনি ১৯৮৬ সালে স্টকটোন রাশকে বিয়ে করেন। সংস্থার তরফেই ওয়েন্ডি যাত্রী নিয়ে টাইটানিক-এর ধ্বংসাবশেষ দেখতে আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে পাড়ি দিয়েছিলেন। এর আগেও দু-বার আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়েছিলেন ওয়েন্ডি, ফিরেও এসেছিলেন সুস্থ্যভাবে। তবে তৃতীয়বারে আর ফায়ার আসা হল না স্ট্রস দম্পতির প্রপৌত্রীর।