Manipur Violence | মণিপুরে সংঘর্ষের শিকার একরত্তি! অ্যাম্বুলেন্সে আগুন ধরিয়ে শিশু-সহ মা ও আরেক মহিলাকে পুড়িয়ে মারল জনতা!
জনজাতি সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল বছর সাতেকের শিশু। চিকিৎসা করতে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল মা ও প্রতিবেশী মহিলা। কিছুটা পথ যেতেই আগুন ধরিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারল উন্মত্ত জনতা।
দীর্ঘদিন ধরেই সংঘর্ষের আগুনে পুড়ছে মণিপুর (Manipur)। সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে একাধিকের। বহু চেষ্টা করেও বাগে আনা যাচ্ছেনা সেখানকার পরিস্থিতি। এবার সেই সংঘর্ষের জেরে বড় দাম দিতে হলো একরত্তি শিশুকে। জঙ্গিহানায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল বছর সাতেকের শিশু। তাকে চিকিৎসা করাতেই অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন মা এবং প্রতিবেশী এক মহিলা। অভিযোগ, কিছুদূর যাওয়ার পর সেই অ্যাম্বুলেন্স দাঁড় করিয়ে আগুন ধরিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় শিশু-সহ দুই মহিলাকে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, এই গোটা নৃশংসতা ঘটেছে পুলিশের সামনেই। নিহতদের পরিবার সরব হওয়ায় ঘটনার দুদিন পর সমাজের সামনে আসে এই ঘটনা।
সূত্রের খবর, রবিবার অর্থাৎ ৪ঠা জুন সন্ধ্যায়, ইম্ফলের ইরোইসেম্বা (Iroisemba, Imphal) এলাকায় এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। জানা গিয়েছে, অসম রাইফেলস বাহিনীর (Assam Rifles) এক ক্যাম্পে একটি বুলেটের স্প্লিন্টার (Splinter) লেগেছিল শিশুটির মাথায়। তাই তাকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। তবে কিছুটা মাঝ পথে গাড়ি থামিয়ে হত্যা করা হয় বছর সাতের টংসিং হ্যাংসিং-কে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার অর্থাৎ ৩রা জুন থেকে গোটা মণিপুর জুড়ে সংখ্যালঘু মেইতেই (Meitei) এবং আদিবাসী কুকি সম্প্রদায়ের (Kuki Community) মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়। আর এতেই বলি হন ৭০ এরও বেশি মানুষ। মণিপুরের কাংপোকপি (Kangpokpi) জেলার কাংচুপ (Kangchup) গ্রামে মূলত কুকি সম্প্রদায়ের মানুষরাই বসবাস করেন। তবে, এই স্থানটি কুকি অধ্যুষিত পাহাড় এবং মেইতেই অধ্যুষিত উপত্যকার মাঝামাঝি এলাকায় অবস্থিত থাকায় সংঘর্ষের কবলে পরে এই গ্রাম। আর এই গ্রামেই বাস করতো সাত বছরের টংসিং।
সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর টংসিং-কে নিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়েছিল তার পরিবার। আশ্রয় নিয়েছিল গ্রামের ঠিক বাইরে অবস্থিত অসম রাইফেলস-এর এক শিবিরে। সেই থেকে শিবিরের ভিতরে একটা জল শোধনাগার হয়ে উঠেছিল তাদের ঠিকানা। সশস্ত্র বাহিনীর শিবিরে আছে, তাই বাইরের হিংসা তাদের ছুঁতে পারবে না, এমনই ভেবেছিল টংসিং-এর পরিবার। কিন্তু ৪ঠা জুন কুকি এবং মেইতেই দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় সংঘর্ষ। চলতে থাকে একে অপরকে লক্ষ্য করে গুলি। তার মধ্যেই গুলির একটি ভাঙা অংশ শিবিরের ভিতরে এসে লাগে টংসিংয়ের মাথায়। টংসিংয়ের মা মীনা হ্যাংসিংয়ের হাতেও ওই গুলির আরেকটি টুকরো লেগেছিল। এরপরই শারীরিক অবনতি ঘটতে থাকে ওই শিশুর। অক্সিজেন দিলেও কোনও লাভ হয়না। ফলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন অসম রাইফেলস-এর কর্তারা।
তাদের কাছে দুটি বিকল্প ছিল, কাংপোকপি জেলার লেইমাখং (Leimakhong) শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া অথবা ২০ কিলোমিটার দূরে রাজধানী ইম্ফলের রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স হাসপাতালে (Regional Institute of Medical Sciences Hospital) নিয়ে যাওয়া। তবে দুই ক্ষেত্রেই ছিল বেশ ঝুঁকি।লেইমাখং কুকি অধ্যুষিত এলাকা। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পথে রয়েছে বেশ কয়েকটি মেইতেই গ্রাম। অন্যদিকে ইম্ফল পুরোপুরি মেইতেই অধ্যুষিত। তবে তার দূরত্ব অনেক কম। দুই বিকল্পই বিবেচনা করে অসম রাইফেলস-এর কর্তারা ঠিক করেন, ইম্ফলেই নিয়ে যাওয়া হবে টংসিংকে। যার ফলে ইম্ফল পশ্চিমের এসপি এস ইবোমচা-কে (SP of Imphal West) ফোন করে একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতেও বলা হয়। টংসিংকে নিতে দ্রুত পৌঁছায় অ্যাম্বুলেন্স। সঙ্গে ছিলেন খোদ ইম্ফল পশ্চিমের এসপি ও তিনটি গাড়িতে এসপি-সহ ছিলেন ১০ পুলিশকর্মী। টংসিং-এর সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্সে ওঠেন তার মা মীনা এবং প্রতিবেশী লিডিয়া লোরেম্বাম। মীনা এবং লিডিয়া দুজনেই ছিলেন মেইতেই সম্প্রদায়ের। আদতে ইম্ফলের বাসিন্দা, মীনা, বিয়ে করেছিলেন কুকি সম্প্রদায়ের জোশুয়া হ্যাংসিংকে। অন্যদিকে লিডিয়া এবং তাঁর স্বামী নওটন লোরেম্বাম মেইতেই হয়েও, কুকি-অধ্যুষিত গ্রামেই থাকতেন শান্তিতে।
রবিবার বিকেল ৫টা নাগাদ ইম্ফলের রিমস হাসপাতালের উদ্দেশ্যে টংসং-কে নিয়ে রওনা দেয় অ্যাম্বুলেন্সটি। কিছুটা এগোতেই মণিপুরের অত্যন্ত শক্তিশালী মেইতেই মহিলাদের সংগঠন, ‘মেরা পাইবিস’রা (Meira Paibis) আটকে দেয় তাদের। সংঘর্ষে উন্মত্ত জনতা আহত শিশুটিকে দেখেও কিছু না ভেবেই আগুন লাগিয়ে দেয় অ্যাম্বুলেন্সে। সেখানেই আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় একরত্তি ও তার মা ও প্রতিবেশী মহিলার। ধ্বংস করা হয় পুলিশের তিনটি গাড়িও। ঘটনায় আহত হন দুই পুলিশ কমান্ডো। কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে পালান এসপি।
সূত্রের খবর, সেদিন অসম রাইফেলসকে যেখানে আটকে দেওয়ার হয়েছিল, তার মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরেই ইম্ফলের ইরোইসেম্বা (Iroisemba) এলাকায় মেইতেইদের একটি বিশাল দল তাদের কনভয়কে আটকেছিল। অসম রাইফেলসের এক কর্তা জানান, মর্মান্তিক ওই ঘটনার আগেই ওই অঞ্চলে গুজব রটে যায় যে, টংসিং-কে যেই অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেই অ্যাম্বুলেন্সে গোপনে কুকি জঙ্গিদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যার ফলে কিছু না ভেবে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা। মণিপুর পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছিলেন ওই ঘটনার পর অ্যাম্বুলেন্স থেকে দেহ বলে কিছু পাওয়াই যায়নি। ঘটনাস্থলে পড়েছিল শুধু দুটি হাড়!
ইরোইসেম্বার এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইতিমধ্যেই শোরগোল পরে গিয়েছে গোটা দেশ সহ প্রশাসনের মধ্যেও। প্রশ্ন উঠছে, ঘটনাস্থলে অসম রাইফেলসের মোতায়েন থাকার পরেও কেন এই ঘটনা ঘটলো, পুলিশ কেন হামলাবাজদের ঠেকাতে পারল না। নিহতদের পরিবার-সহ মণিপুরের শান্তিকামী মানুষের প্রশাসনের কাছে দাবি, এই জনজাতি সংঘর্ষ দ্রুত থামানোর ব্যবস্থা নিতে হবে, নাহলে প্রতিদিনই টংসিং-এর মতো অনেক একরত্তিই চলে যাবে 'না ফেরার দেশে'।
- Related topics -
- দেশ
- মনিপুর
- মনিপুর জনজাতি সংঘর্ষ