Saraswati Puja 2024 | কেবল বিদ্যার নয়, বৈদিক সাহিত্যে নদী বা জলাশয়ের দেবী হিসেবেও পূজিত সরস্বতী! জানুন সরস্বতী পুজো ও বাগদেবীর মাহাত্ম্য!
সরস্বতী দেবীর 'সরস্বতী' শব্দটি 'সরস্' ও 'বতী' শব্দের সন্ধি। সংস্কৃত ভাষায় এই শব্দের অর্থ হলো- হ্রদ বা জলাশয়ের অধিষ্ঠাত্রী। সরস্বতী পুজা ২০২৪ এর দিনে বিশেষ কাকতালীয় যোগ তৈরি হতে চলেছে। জানুন কেন মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতেই পূজিত হন বাগদেবী?
আর দিন কয়েক পরেই বাগদেবীর আগমন। ১৪ই ফেব্রুয়ারি সরস্বতী পুজা ২০২৪ (Saraswati Puja 2024)। বাঙালির অন্যতম জনপ্রিয় উত্সব সরস্বতী পুজা (Saraswati Puja)। বসন্ত পঞ্চমীতে আরও একবার সরস্বতী পুজোয় ব্রতী হতে তৈরি হিন্দু বাঙালিরা। হিন্দু ধর্মমতে, দেবী সরস্বতীকে জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী বলা হয়। তবে বৈদিক সাহিত্যে সরস্বতী দেবী (Saraswati Devi) এর পরিচয় জলাশয় ও নদীর দেবী হিসাবে। ক্যালেন্ডার অনুসারে, মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতী পুজা (Saraswati Puja) করা হয়। ফলে এই পুজোকে বসন্ত পঞ্চমীও বলা হয়। এই বিশেষ দিন থেকে, শিশুরা বর্ণমালার সঙ্গেও পরিচিত হয়। ফলে এই পুজোতে বিশেষভাবে আগ্রহ দেখা যায় ছাত্র-ছাত্রীদের। সরস্বতী ঠাকুর (Saraswati Thakur) আনা থেকে শুরু করে মণ্ডপ সাজানো, সব কিছুইতেই অংশ নেয় পড়ুয়ারা। তবে অনেকেই জানেন না কী কারণে মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতেই পূজিত হন সরস্বতী দেবী। আবার অনেকেই জানেন না, কেবল বিদ্যার দেবী হিসেবে নয়, জলাশয় ও নদীর দেবী হিসাবেও পরিচিত সরস্বতী ঠাকুর (Saraswati Thakur)।
কেন মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতেই পূজিত হন দেবী সরস্বতী?
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, বসন্ত পঞ্চমীর দিনে জ্ঞানের দেবী সরস্বতী আবির্ভূত হয়েছিলেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা ব্রহ্মাদেব যখন পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন, তখন তিনি অনুভব করেছিলেন কোনও কিছু অনুপস্থিত রয়েছে। শব্দ সঞ্চারের জন্য তিনি তাঁর কমণ্ডলু থেকে পৃথিবীতে জল ছিটিয়ে দেন। আর ঠিক সেই সময়ই পৃথিবী কাঁপিয়ে আবির্ভূতা হয়েছিলেন সরস্বতী দেবী (Saraswati Devi)। হাতে ছিল তাঁর বীণা, জপমালা ও বই। দেবী সরস্বতী তার বীণার সঙ্গে বসন্তের রাগ বাজিয়েছিলেন। সৃষ্টি তাঁর বীণার ধ্বনি থেকে বাক ও সঙ্গীত লাভ করে। দেবী জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়েছেন, যা থেকে বিশ্বকে জ্ঞানের আলো প্রসারিত হয়েছে। এই কারণেই বসন্ত পঞ্চমীর দিন সরস্বতীর বিশেষ পূজা করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বাস করা হয় দেবী সরস্বতীর পুজোর দিন বই পুজো করলে তা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান আশীর্বাদস্বরূপ হয়। এটি অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয় । শুধু বই নয়, সরস্বতী পুজোর দিনে জ্ঞান দানকারী এমন প্রতিটি বস্তুরই পুজো করা উচিত। এই কারণে অনেকেই নিজেদের ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, বাদ্যযন্ত্র এবং এই জাতীয় অন্যান্য জিনিসও পুজো করে থাকেন।
সরস্বতী পুজা ২০২৪ :
নতুন বছর পড়তে না পড়তেই সরস্বতী পুজোর জন্য সকলে মুখিয়ে রয়েছেন৷ এদিন প্রতিটি ঘরে ঘরে বাগদেবীর আরাধনা হয়৷ শিক্ষা-শিল্পকলা-সঙ্গীতের দেবী মা সরস্বতীর পুজো এই বছরের ১৪ই ফেব্রুয়ারি পড়েছে। চলতি বছরে সরস্বতী পুজোর শুভ যোগ - মাঘ শুক্ল পঞ্চমী তিথি ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪ দুপুর ০২.৪১ মিনিটে শুরু হবে এবং ১৪ ই ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২.০৯ মিনিটে শেষ হবে। এই দিনে বীণাপাণি দেবী সরস্বতীর আরাধনা করলে বুদ্ধি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধি পায়, এমনতাই মত। সরস্বতী পুজোর শুভ সময় সকাল ০৭.০১ মিনিটে থেকে দুপুর ১২.৩৫ মিনিট পর্যন্ত। অর্থাৎ শুভ সময়ে পুজো করার জন্য ৫ ঘন্টা ৩৫ মিনিট সময় পাবেন। এই সময় কাজ শুরু করার জন্য সর্বোত্তম বলে মনে করা হয়।
উল্লেখ্য, সরস্বতী পুজা ২০২৪ (Saraswati Puja 2024) এর দিনে বিশেষ কাকতালীয় যোগ তৈরি হতে চলেছে। যার কারণে পুজোর গুরুত্ব আরও বেড়ে গিয়েছে। ২০২৪ সালে, সরস্বতী পুজো দ্বারা প্রদত্ত রবি যোগ এবং রেবতী নক্ষত্রের একটি কাকতালীয় ঘটনা রয়েছে। যেখানে কোনো শুভ কাজ শুরু করলে সাফল্য আসে। দীর্ঘ সময় ধরে শুভ ফল পাওয়া যায়। রবি যোগ সকাল ১০.৪৩ মিনিট থেকে পরের দিন সকাল ৭টা পর্যন্ত চলবে। রেবতী নক্ষত্র সকাল ১০টা ৪৩ মিনিট পর্যন্ত থাকবে। মা সরস্বতীর কৃপায় কর্মজীবনে উন্নতি লাভ করা যেতে পারে বলে বিশ্বাস।
জলাশয় ও নদীর দেবী হিসেবে সরস্বতী :
মানব সভ্যতার প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋকবেদে প্রথম দেবী সরস্বতীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সংস্কৃত ব্যকরণের অনুসারে 'সরস্বতী' শব্দটি 'সরস্' ও 'বতী' শব্দের সন্ধি। সংস্কৃত ভাষায় 'সরস্' শব্দটি হ্রদ বা জলাশয় হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সেই অনুসারে সরস্বতী শব্দের অর্থ হলো- হ্রদ বা জলাশয়ের অধিষ্ঠাত্রী। ঋকবেদের দ্বিতীয় মণ্ডলের ৪১তম সুক্তের ১৬তম স্লোকে বলা হয়েছে, ‘অম্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতি’। যার অর্থ - সরস্বতী মা নদীদের মধ্যে ও দেবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এছাড়াও ঋকবেদে একাধিক জায়গায় সরস্বতীকে নদীর দেবতা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
পাবকা নঃ সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী। যজ্ঞং বষ্টু-ধিয়াবসুঃ।। দয়িত্রী সূনৃতানাম্ চেতন্তী সুমতীনাম্। যজ্ঞং দধে সরস্বতী।। মহো অর্ণঃ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি।।
ঋকবেদে মা সরস্বতীকে জ্ঞানদাত্রীর পাশাপাশি অন্নদাত্রী, শিক্ষাদাত্রী ও জলদাত্রী। বৈদিক সভ্যতা যত এই নদীর আশীর্বাদ পেয়েছে, ততই দেবীর গরিমায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন মা সরস্বতী। তাঁকেই এই সভ্যতার ধাত্রীদেবী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। কোনও কোনও পুরাণের মতে, তিনি ব্রহ্মার মানসপুত্রী। এখনের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বৈদিক নদী সরস্বতীর ধারণা পাওয়া যায়। বৈদিক সভ্যতার প্রাণ ছিল এই নদীর জলধারা। কিন্তু কালক্রমে তা হারিয়ে যায় সময়ের অতলে। সিন্ধু সভ্যতাও প্রধানত সরস্বতীর জলেই পুষ্ট। এখনের যমুনা নদী এককালে হারিয়ে যাওয়া সরস্বতীর উপনদী ছিল। মহাকাব্য ও পুরাণেও রয়েছে, কৃষ্ণের দাদা লাঙল বা হলধারী বলরাম একবার যমুনাকে কর্ষণ করেছিলেন। এই পৌরাণিক কাহিনীতেই নদীর গতিপথ পাল্টে যাওয়ার ঘটনাটি স্পষ্ট। সময়ের কোনও এক অধ্যায়ে বিশাল ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের কারণে রাজস্থানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হারিয়ে যায় সরস্বতী নদীর গতিপথ। তবে অনেক ঋষির ধারণা, অন্তঃসলিলা হয়ে সরস্বতী আজও বয়ে চলেছে। সরস্বতী নদী যে ছিল এ কথা দীর্ঘ গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়েছে।
অনেকের মতে, ব্রহ্মা সরস্বতীকে সঙ্গে নিয়ে এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। বিপুল জলধারার নদী ছাড়া যে সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না তা সহজেই অনুমান করা যায়। সরস্বতীকে ব্রহ্মার স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করা হয়। তবে অনেক পুরাণ মতে, তিনি বিষ্ণুর স্ত্রী ছিলেন। পণ্ডিতরা মনে করেন, দেবগুরু বৃহস্পতির সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পর সরস্বতী জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী হিসাবে পূজিত হতে শুরু করেন। দেবগুরু বৃহস্পতিই হলেন আসলে জ্ঞান। ফলে পণ্ডিতদের একাংশের মতে সংস্কৃতের ‘সরস্’ শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে ধরলে ভুল হবে। এখানে সরস্ অর্থে জ্ঞানকেই বোঝানো হয়েছে। আর সরস্বতীকে জ্ঞানের আধার হিসাবে। তবে ঋগ্বেদেও তাঁর জ্ঞানের বিচ্চুরণের কথা জানা যায়। এছাড়াও অথর্ব ও যজুরবেদে সরস্বতীকে নানা ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তার মধ্যে বাংলায় সরস্বতীর বীণাপানি রূপটি পূজিত হয়ে থাকে। সেই রূপ অনুযায়ী, দেবীর দুই হাত। একটি হাতে থাকে পুস্তক, অন্য হাতে থাকে বীণা। শ্বেতশুভ্র রাজহংসে অধিষ্ঠিত হয়ে কমলে পা রেখে মর্তে আসেন দেবী।
- Related topics -
- অন্যান্য
- পুজো ও উৎসব
- বসন্ত
- লাইফস্টাইল
- সরস্বতী পুজো