Puri Lord Jagannath | বর্বর শবরদের ‘ট্রাইবাল গড’ থেকে রাজ-পুরী! ৯০০ বছর পরেও নীচবর্ণের হাতে পুজো পান ভক্তের ভগবান প্রভু জগন্নাথ

জগতের নাথের সঙ্গে শবরদের যোগাযোগ জানতে হলে আমাদের আগে এই প্রাচীন আদিবাসী জাতিকে চিনতে হবে। শবররা কুঠার হাতে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। কাঠ কেটে তা বেঁচে এবং শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই বনবাসী যাযাবর জাতির মধ্যে বিকলাঙ্গ দেবতার পূজার প্রচলন ছিল। 'কিটুঙ' নামে শবরদের এক সাধু একদিন পাথর ভাঙতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। আচমকা এক আগুনের শিখায় কিটুঙয়ের দুটি পা পুড়ে যায়। আঘাত লাগে মাথায়ও । মরন্নাপন্ন কিটুঙ আদেশ দেন ঐরকম বিকলাঙ্গ রূপেই দেবতাদের মূর্তি গড়িয়ে পুজো করতে। অনুমান করা যায়, বিকলাঙ্গ প্রভু জগন্নাথ আসলে আদিবাসীদেরই আরাধ্য।
"রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,/ ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।"
৩৩ কোটি দেবতার দেশ ভারতবর্ষ। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধারী নারায়ণ পূজিত হন নানারূপে। ওড়িশায় তিনি অর্ধদেহধারী জগন্নাথ। নীচবর্ণের শবরের হাতে পুজো পান এই নীলমাধব। জগন্নাথ একমাত্র এমন ভগবান যার দুহাত সামনের দিকে বাড়ানো। যেন তিনি সর্বদা আহ্বান করছেন ভক্তদের। সর্বদা ডাকছেন নিজের কাছে, আরও কাছে। শিশুসুলভ বড়ো বড়ো চোখে পৌঁছতে চাইছেন ভক্তদের মনের শেষপ্রান্ত অবধি। আজ রথযাত্রা, পুরীর মন্দিরে সাজো সাজো রব। নন্দীঘোষ রথে চড়ে পুরীর রাস্তায় বের হবেন প্রভু জগন্নাথ। তাঁর শ্রীমুখ দর্শনের জন্যে মুখিয়ে আছে লাখো লাখো ভক্তকূল।

তবে ভারতবর্ষের অন্যান্য মন্দিরের বিগ্রহের মতো এই দেবতার পুজো কিন্তু ব্রাহ্মণদের কুক্ষিগত নয়। স্নানযাত্রা থেকে রথযাত্রা, দারুব্রহ্ম জগন্নাথের পুজার্চর্নার ভার থাকে নীচবর্ণের বনবাসী শবর সম্প্রদায়ের হাতে। কিন্তু কেন এই অদ্ভুত নিয়ম? চলুন রথযাত্রার এই পুন্যদিনে জেনে নিই ভক্তের ভগবান প্রভু জগন্নাথ কেন পুজো পান শবরদের হাতে।
জগন্নাথের শবর সংযোগ :
তিনখানা কাঠের মূর্তি, সম্ভবত ভারতের একমাত্র কাষ্ঠদেবতা, অদ্ভুত দর্শন দেহ অথচ উঁচ নীচ সমস্ত বর্নের প্রজারাই যার মহাপ্রসাদ পেয়ে আসছেন ৯০০ বছর ধরে, এমন উদাঃহরণ বিরল। জগন্নাথের এই সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রাচীন পুরীনগরীতে। পুরাকালে সে এলাকা নীচ জাতির আদিবাসী সম্প্রদায় শবরদের রাজত্ব ছিল। পুরাণ বলছে, এই শবরদের রাজা বিশ্ববসু নদীতে ভেসে আসা একখণ্ড নীল রঙা পাথরকে নীলমাধব রূপে পুজো করতেন।

রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য এই খবর জানতে পেরে ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতিকে দিয়ে ছলে বলে কৌশলে শবরদের আরাধ্য দেবতাকে চুরি করে পুরীর মন্দিরে স্থাপন করে পূজার্চনা শুরু করেন। তবে নীলমাধবের আদি মূর্তিতে নয়, রাজা এই ভগবানের দেখা পেয়েছিলেন অদ্ভুতদর্শন অর্ধদেহধারী জগন্নাথ মূর্তিতেই।
জগন্নাথের এই বিকলাঙ্গ রূপের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিশ্বামিত্রের কারিগরি এবং রাজার সময়ের আগে দরজা খোলার কাহিনী। তবে জগতের নাথের সঙ্গে শবরদের যোগাযোগ জানতে হলে আমাদের আগে এই প্রাচীন আদিবাসী জাতিকে চিনতে হবে। শবর কথাটির উৎপত্তি হয়েছে ‘সগর’ থেকে। স্কাইথিয়ান ভাষায় ‘সগর’ শব্দের অর্থ হলো কুঠার। বোঝাই যাচ্ছে, শবররা কুঠার হাতে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। কাঠ কেটে তা বেঁচে এবং শিকার করে এরা জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই বনবাসী যাযাবর জাতির মধ্যে বিকলাঙ্গ দেবতার পূজার প্রচলন ছিল। 'কিটুঙ' নামে শবরদের এক সাধু একদিন পাথর ভাঙতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। আচমকা এক আগুনের শিখায় কিটুঙয়ের দুটি পা পুড়ে যায়। আঘাত লাগে মাথায়। মরন্নাপন্ন কিটুঙ আদেশ দেন ঐরকম বিকলাঙ্গ রূপেই দেবতাদের মূর্তি গড়িয়ে পুজো করতে।

অনুমান করা যায়, বিকলাঙ্গ প্রভু জগন্নাথ আসলে আদিবাসীদেরই আরাধ্য। একারণেই ওড়িষ্যা এবং জগন্নাথদেবের নাম উঠলেই অবশ্যম্ভাবী ভাবে শবরদের কথা উঠবেই। এই আদিম আদিবাসীরা জগন্নাথের প্রিয় দয়িতা, সেবক এবং আত্মীয়।
জগন্নাথের পূজার্চনায় শবরেরা :
আমরা জানি, বংশ পরম্পরায় পুরীর মন্দিরের পুজোর দ্বায়িত্ব পালন করেন দৈতাপতিরা। কারা এই দৈতাপতি? কেনই বা জগন্নাথের পুজোয় তাঁদের অধিকার সবার আগে? মধ্য যুগের ওড়িশার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ রোল্যাঁ হার্ডেনবার্গ বলছেন, ‘দৈতা’ শব্দটি এসেছে দৈত্য থেকে। বনবাসী শবরদের লম্বা, কালো দেহগঠনই এই উপমার জন্যে দায়ী। এই দৈতাপতিরা আসলে নীলমাধবের উপাসক শবররাজ বিশ্বাবসুর উত্তরসূরি। রথযাত্রার আগে প্রভু জগন্নাথের 'নবকলেবর' উৎসবের দ্বায়িত্বে থাকেন দৈতাপতিরা।

পুরুষোত্তম ক্ষেত্র পুরীতে জগন্নাথকে বলা হয় দারুব্রহ্ম। কিছু বছর পরপর এই নিম কাঠের বিগ্রহ বদলে ফেলা হয়। জগন্নাথদেবের দইতাপতি সেবকরাই 'নব কলেবর' ও “ব্রহ্ম” পরিবর্তনের দায়িত্ব পালন করেন। এযুগেও দৈতাপতিরা স্বপ্নযোগে জানতে পারেন বিগ্রহ নির্মাণের উপযুক্ত নিমগাছ কোন কোন জায়গায় পাওয়া যাবে। পুরীর কাকটপুরে মঙ্গলাদেবীর মন্দিরের কাছ থেকে দৈতাপতিরা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে বিগ্রহগুলির কাঠের জন্য নতুন গাছের সন্ধানে বেরোন। জগন্নাথের বিগ্রহ গড়াতে হয় এমন গাছের কাঠ দিয়ে যে গাছে কোনও পাখির বাসা থাকা চলবে না, মূলে বিষধর সাপের বাসা থাকতে হবে। থাকতে হবে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মের চিহ্ন। তিন, পাঁচ বা সাতটি করে শাখা থাকতে হবে। জগন্নাথের বিগ্রহ হবে হবে কৃষ্ণবর্ণ গাছের কাঠ থেকে, বলরামেরটি শ্বেতবর্ণ, সুভদ্রার রক্তবর্ণ।

যথোচিত পুজো অর্চনার পর গাছগুলিকে কেটে পুরীর মন্দিরের কোইলি বৈকুন্ঠে আনা হয়। সেখানেই দৈতাপতিদের তত্বাবধানে শুরু হয় মূর্তি গড়ার কাজ। যাঁরা বিগ্রহগুলি নির্মাণ করেন তাঁদের বলা হয় বিশ্বকর্মা। নীচ বর্ণের শবরদের হাতের কারুকার্যে ১০ দিনেই কাঠ থেকে মূর্তিতে রূপান্তরিত হন প্রভু জগন্নাথ।

তবে শুধু মূর্তি বানানোই নয়, মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা অর্থাৎ 'ব্রহ্ম' পরিবর্তনেরও দ্বায়িত্বে থাকেন এই দৈতাপতিরা। মূর্তি নির্মাণের সময় প্রতিটি শ্রীঅঙ্গে একটি ছোট গর্ত করা থাকে। “শুদ্ধ আষাঢ়’ মাসের অমাবস্যার দিন চোখ বেঁধে ‘ব্রহ্ম’ পরিবর্তনের কাজ সুসম্পন্ন করেন এক প্রবীন দৈতাপতি। দেবতার হৃদয় বহন করে প্রতিষ্ঠা করেন নবকলেবরে।

কথিত আছে, এই ‘ব্রহ্ম’ পরিবর্তনের কাজ করেন যিনি তিনি বেশিদিন বাঁচেন না। এদিকে তিন বিগ্রহ ও সুদর্শনকে কোইলি বৈকুন্ঠেই প্রায় ৯ হাত গভীর ও ৬ হাত ব্যসার্ধের একটি গর্তে রেশমের বস্ত্র ও তুলোর বালিশে শুইয়ে সমাধি দেওয়া হয়। তাঁদের জন্যে অশৌচ পালনও করেন দৈতাপতিরা। কারণ জগন্নাথ তো শুধু দেবতা নন, তিনি যে শবরদের পরমাত্মীয়ও।

স্নানযাত্রা থেকে রথযাত্রা এই 'অনবসর' কালে শবরদের অধীনেই পরিচালিত হয় জগন্নাথের পূজার্চনা। প্রভুর বেশিরভাগ দ্বায়িত্ব দৈতাপতিরা নিলেও চক্ষুদানের ভার কিন্তু থাকে ব্রাহ্মণদের হাতেই। জগন্নাথের মহাপ্রসাদও সকল বর্ণের মানুষ গ্রহণ করেন নির্দ্বিধায়। ভূভারতে একমাত্র শ্রীক্ষেত্রেই উঁচ নীচ বর্ণের এমন অসাধারণ সমন্বয় দেখা যায়। জাতপাত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ভক্তদের দিকে ভালোবাসার দু হাত বাড়ান দারুব্রহ্ম কাষ্ঠমূর্তি। এই অসম্পূর্ন হাত যেন স্বীকৃতির হাত। জাতি, বর্ণ, গায়ের রং, দেহবৈকল্য, জরা, ব্যাধি নির্বিশেষে তিনি যেন মেনে নেন ভক্তদের। তিনি যেন ভালোবাসেন নিঃশর্তভাবে। As devotion is the highest form of love and Love knows no bounds.

- Related topics -
- পুজো ও উৎসব
- রথযাত্রা
- জগন্নাথ মন্দির
- পুরী
- মন্দির
- দেশ
- ভারত