দেশ

Guru Nanak Jayanti Gurpurab 2023 | কার্তিক পূর্ণিমার তিথিতে বিশ্বজুড়ে উদযাপিত গুরু নানক জয়ন্তী! জানুন এই দিনের মাহাত্ম্য!

Guru Nanak Jayanti Gurpurab 2023 | কার্তিক পূর্ণিমার তিথিতে বিশ্বজুড়ে উদযাপিত গুরু নানক জয়ন্তী! জানুন এই দিনের মাহাত্ম্য!
Key Highlights

গুরু নানকের জন্মজয়ন্তী বা গুরপুরব উপ-উপলক্ষ্যে দেশ-বিদেশের সকল গুরুদ্বার আলো, ফুল দিয়ে সেজে ওঠে। জানুন এই বিশেষ দিনের তাৎপর্য এবং গুরু নানকের মতবাদ।

  প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমায় শিখ (Sikh) ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম ধর্মগুরু গুরু শ্রী গুরু নানক দেব জি (Sri Guru Nanak Dev Ji)র জয়ন্তী পালিত হয়। শিখ ধর্মাবলম্বীদের জন্য এই তিথিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনটিকে গুরু নানক জয়ন্তী (Guru Nanak Jayanti) বা গুরপুরবও বলা হয়ে থাকে। চলতি বছর এই বিশেষ তিথি অর্থাৎ গুরপুরব ২০২৩ (Gurpurab 2023) পড়েছে ২৭সে নভেম্বর, সোমবার। শিখ ধর্মাবলম্বীরা পূর্ণিমার দুদিন আগে থেকে উৎসবে মেতে ওঠেন। এদিন দেশ-বিদেশের সকল গুরুদ্বার আলো, ফুল দিয়ে সেজে ওঠে। গুরুদ্বার (Gurudwara) কর্তৃপক্ষর তরফ থেকে ব্যবস্থা করা হয় বিশেষ আহারেরও। জাতী ধর্ম নির্বিশেষে এই দিন একসঙ্গে প্রসাদ উপভোগ করেন। গুরু নানক জয়ন্তীতে জেনে নিন এই পবিত্র দিন সম্পর্কে বিষেশ কিছু অজানা তথ্য।

গুরু নানকের জীবন কাহিনী :

১৪৬৯ সালে কার্তিক পূর্ণিমার দিনে শ্রী গুরু নানক দেব জি (Sri Guru Nanak Dev Ji) জন্মগ্রহণ করেন পাকিস্তানের, তালওয়ান্ডি নানকন সাহিব-এ। যা তৎকালীন দিল্লির সুলতানত এর একটি প্রদেশ ছিল। বর্তমানে এই জায়গাটি পাকিস্তানের নানকান সাহেব নামে পরিচিত। তাঁর পিতা কালুরাম মেহতা জী খাতরি এবং তাঁর মাতা তৃপ্তা দেবী। স্ত্রীর ছিলেন মাতা সুলক্ষণী। জন্মসূত্রে গুরু নানক সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। বাল্যকালেই ধর্মগুরু নানকের মধ্যে প্রবল আধ্যাত্মিক ভাবের প্রকাশ দেখা যায় । তার সমবয়সী ছেলেরা যখন খেলা করত , তখন দেখা যেত গুরু নানক নির্জনে একাকী বসে আছেন। সবসময়েই তাঁর মধ্যে একটা উদাসভাব । যেন বিশ্ব সংসারের যাবতীয় সমস্যা গুরু নানকের মাথায় ভর করছে। কথিত আছে, তালওয়ান্দি গ্রামের কাছাকাছি অরণ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধুদের আস্তানা ছিল সেখানে পাঁচবছর বয়স থেকেই নানক যাতায়াত করতেন । তাদের কাছ থেকে শুনতেন জীবন মৃত্যু প্রভৃতি বিষয়ে সাধুদের গূঢ় আলোচনা।

বাল্যকাল থেকেই ঈশ্বর-ধর্ম বাদে অন্য কিছুতে মন লাগতো না নানকের। পাঠশালাতে ভর্তি হলেও মন ছিল না তাঁর। ফলে পিতার আদেশে পাঠশালায় যাবার পরিবর্তে তিনি প্রতিদিন সকালে গরু – ছাগল নিয়ে মাঠে যেতে লাগলেন নানক। সেখানেই তাঁর আধ্যাতিক রূপের পরিচয় পায় গোটা বিশ্ব। বলা হয়, ছোট বেলায় বাড়ির পাশের জমিতে গবাদি পশুগুলিকে ছেড়ে দিয়ে গাছতলায় বসে বিশ্রাম করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তেন নানক। এরকমই একদিন নানক ঘুমিয়ে পড়ার পর তাঁর গবাদি পশুগুলি অন্যের শস্যক্ষেতে ঢুকে গিয়ে শস্য নষ্ট করে দেয়। ঘটনার প্রতিবাদে খেতের মালিক জমিদারের কাছে গিয়ে নালিশ জানায়। ধরে নিয়ে আসা হয় নানককেও। তবে নানায়ক বলেন, কোনও শস্য নষ্ট হয়নি। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় জমির ফসল যেমন ছিল তেমনি আছে। এরকমই আরেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে কিছুদিন পরেই। সেদিনও মাঠে গরু ছেড়ে দিয়ে নানক গাছতলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরন্তু বেলার রোদ এসে পড়ছিলো তার মুখে। গ্রামের জমিদার রাইবুলার কাজে সেই সময় যাচ্ছিলেন সেই পথ দিয়েই। যেতে যেতে তখন তিনি দেখেন এক বিষধর সাপ নানকের মাথার কাছে রোদ আড়াল করে ফনা তুলে আছে। তার পায়ের শব্দ পেয়ে আস্তে আস্তে সাপটি চলে গেল। রাইবুলার বুঝতে পারলেন , নানক সাধারণ মানুষ নয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘর সংসারের প্রতি নানকের উদাসীনতাও বাড়তে থাকে নানকের। প্রায়ই দেখা যেত তিনি নির্জনে ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছেন বা গাঁয়ে কোন সাধু সন্ন্যাসী এলে তিনি তাদের কাছে গিয়ে ঈশ্বরের কথা ধর্ম উপদেশ শুনছেন।

গুরু নানক এর ধর্ম প্রচার :

১৪৯৬ সালে নানকজি তাঁর পরিবার ত্যাগ করেন এবং তাঁর শিক্ষা প্রচারের জন্য আধ্যাত্মিক জীবন যাত্রা শুরু করেছিলেন। দীর্ঘ প্রায় পঁচিশ বছর ব্যাপী গুরু নানক বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন । জগতের নানা বিষয়ে ব্যাপক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নানক ভারতের কর্তারপুর গ্রামে এসে বসবাস করতে থাকেন । নানক একজন সাধারণ কৃষকের ন্যায় জীবন যাপন করতেন । তিনি এরপর তাঁর ধর্মপ্রচারে মনোনিবেশ করেন। ঈশ্বরের সাধন-ভজনের পাশাপাশি ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে প্রায় সারা ঘুরেছেন নানকজি। তাঁর এই ভ্রমণ 'ভাই গুরদাস' নামে পরিচিত। সুলতানপুর লোধি থেকে যাত্রা শুরু করে তিনি প্রথম পর্যায়ে পা রাখেন হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ এমনকি বাংলাদেশেও। দ্বিতীয় ভ্রমণকালে সমস্ত দক্ষিণ ভারত দেখার পর তিনি পৌঁছে যান শ্রীলঙ্কায়। তৃতীয় পর্যায়ে নানকজি পৌঁছোন হিমালয়ের ধর্মীয় স্থান, তিব্বত, লাদাখ, কাশ্মীর এবং পাকিস্তানে। বিশ্বোর পশ্চিম অংশে ভ্রমণের সময়েই নানকজি বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নিয়েছিলেন কর্তারপুরে। কথিত আছে, নারওয়াল জেলার অন্তর্গত এই কর্তারপুরেই জীবনের শেষ ১৮টি বছর কাটিয়েছিলেন গুরু নানক। ঐতিহ্য অনুসারে গ্রামটি আসলে একজন ধনী ভক্ত নানককে সম্মান জানাতে তৈরি করেছিলেন। সম্ভবত এই চূড়ান্ত সময়কালেই নতুন শিখ সম্প্রদায়ের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল।

গুরু নানকের মৃত্যুর প্রকৃত বছরটি বিতর্কিত। অনেকের বিশ্বাস গুরু নানকের দেহাবসান হয় ১৫৩৮ সালে আবার অনেকের মতে ১৫৩৯ সালে। নানকের দেহাবসানের পর সেখানে নির্মিত হয়েছে কর্তারপুর গুরুদ্বার (Gurudwara) শ্রী দরবার সাহিব বা কর্তারপুর সাহিব। যা আজও বিশ্বের সমস্ত শিখধরমাবলম্বীদের কাছে অন্যান্য গুরুদ্বারের মধ্যে এটি অন্যতম জনপ্রিয় ধর্মস্থান।উল্লেখ্য, নানক তাঁর শিষ্যদের একজন,অঙ্গদকে নানক তার আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং নানকের মৃত্যুর পর তিনি গুরু অঙ্গদ হিসেবে তরুণ শিখ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

শিখ ধর্ম ও গুরু নানকের মতবাদ :

নানকজি ইসলাম এবং হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি সবসময়ই বলতেন যে, হিন্দু বা মুসলমান বলে কিছু নেই। তাঁর  মত অনুসারে স্মরণ করার মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে সংযোগ স্থাপন করা যায়। যে কোন নামে ঈশ্বরের উপাসনা করা যায় এবং ঈশ্বরের কাছে নিজের সমস্ত প্রার্থনা জানানো যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীতে তিনি শিখ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। গুরু নানক তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ্যে যে উপদেশামৃত ও মহামূল্যবান বাণী বিতরণ করতেন , সেইসব উপদেশাবলী ও বাণীর সংকলিত রূপ , ‘গুরু গ্রন্থসাহেব’ (Guru Granth Sahib)। গুরু গ্রন্থসাহেব শিখদের কাছে মহাপবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত । শিখরা ধর্মের ব্যাপারে যথেষ্ট রক্ষণশীল । তবে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষহীন।

এই ধর্ম অনুসারে শিখ ধর্মের তিনটি মূলনীতি হল-

  • ১) নাম জাপানা অর্থাৎ সারাক্ষণ ঈশ্বরের স্মরণ করা,
  •  ২) কিরত কর্ণ অর্থাৎ নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবা করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা,
  • ৩) ভন্ড ছকনা, যার মানে হল আপনার যা কিছু আছে তা সকলের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়া।

তাঁর শিক্ষায় বিভিন্ন নীতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা ধার্মিকতা, পবিত্রতা এবং নিঃস্বার্থ সেবার গুণাবলী সম্পর্কিত এক ঈশ্বরের নামে বিশ্বাস করা হয় এবং ধ্যানের পাঠ রয়েছে। শিখ ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে, পরবর্তী শিখ গুরুদের গুরুপদ লাভের সময় তাদের মধ্যে গুরু নানকের ঐশ্বরিক ক্ষমতা, ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও পবিত্রতা প্রবাহিত হয়ে থাকে। তিনি বহু জায়গায় ভ্রমণ করে মানুষের মধ্যে এক ঈশ্বরের মতবাদ প্রচলন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তিনি সমতা, সদা আচরণ, ভ্রাতৃত্ববোধ এর উপরে নির্ভর করে একটি অনন্য ধর্মীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

গুরু নানক জয়ন্তী বা গুরপুরব :

শিখ সম্প্রদায়ের কাছে গুরু নানক জয়ন্তী বা গুরপুরব এই দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ।  কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে গুরু নানক জন্ম জয়ন্তী পালন করা হয়, যা সাধারণত অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে পরে। চলতি বছর গুরু নানক জয়ন্তী বা গুরপুরব ২০২৩ (Gurpurab 2023) পড়েছে ২৭সে নভেম্বর। এ বছর তাঁর ৫৫৪ তম জন্মদিবস। গুরু নানক জন্ম জয়ন্তী পালন করা হয় গুরু নানক দেব-এর জন্মদিন এবং তাঁর শিক্ষনীয় কাজগুলিকে উদযাপন করার জন্য। তিনি সর্বদা ভালোবাসা, একতা এবং নিঃস্বার্থ সেবাররর কথা প্রচার করেছেন। শিখ ধর্মের মানুষরা এখনও সেইসব বার্তা নিষ্ঠাসহ মেনে চলেন।

শিখ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা গুরু পর্বের ১৫ দিন আগে প্রতি ভোরে প্রভাত ফেরির আয়োজন করে।  তাছাড়া শিখ ধর্মাবলম্বীরা গুরু নানক দেবের শিক্ষা অনুসরণ করে শপথ গ্রহণ করেন। এর পাশাপাশি গুরু পর্বের দিন ভোর ৪ টের সময় প্রার্থনা দিয়ে দিন শুরু হয়। এই সময়টি অমৃত ভেলা নামেও পরিচিত। দুদিন আগে থেকেই, মানে ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকেই টানা গুরু গ্রন্থসাহিব পাঠ শুরু করা হয়। আর নানক জয়ন্তীর ২৪ ঘণ্টা আগে একটি নগরকীর্তনের আয়োজন করা হয়। চলে মন্ত্রপাঠ ও ভজনগান। এ সময় গুরুদ্বারা ফুল ও আলো দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়। প্রধান দিন অমৃত বেলায় এই উৎসব শুরু হয়। সকালে ভজন করার পর কাহিনি পাঠ এবং কীর্তন করা হয়ে থাকে। প্রার্থনার পর লঙ্গর বা ভান্ডারা করা হয়। লঙ্গরের পর কথা ও কীর্তনের পাঠ জারী রাখা হয়। রাতে গুরবাণী গায়নের পর উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। গুরু নানক জয়ন্তীর শুভ দিনে শিখ সম্প্রদায়ভুক্তরা নানান স্থানে লঙ্গরের আয়োজন করেন। এখানে শুদ্ধ ও নিরামিষ খাবার যেমন কড়ি, চাল, লুচি, আলু, দাল রুটি এবং পায়েস খাওয়ানো হয়।

তাছাড়া নিশান সাহেব পতাকা নিয়ে মিছিল শুরু হয়। পালকি বহন করা হয় এবং সেই পালকিতে থাকে গুরুগ্রন্থ সাহেব, মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ধর্মীয় গান গেয়ে থাকেন। এরপর  শুরু হয় দুয়ারে ফিরে খাবার বিতরণ করা, যেখানে অগণিত দরিদ্ররা এসে খাবার খেয়ে থাকেন। এইভাবে গুরু নানকের জন্মদিন উপলক্ষে শিখ ধর্মের মানুষেরা প্রতি বছর তাকে শ্রদ্ধা জানাতে এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন অনুসারে তাকে এই দিনটি উৎসর্গ করে থাকেন।