Dr Bidhan Chandra Roy | 'পশ্চিমবঙ্গের রূপকার' ছিলেন দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ্য চিকিৎসকও! ডঃ বিধান চন্দ্র রায়কে সম্মান জানাতেই পালন হয় চিকিৎসক দিবস!
ঈশ্বরতুল্য চিকিৎসকদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্যই প্রতিবছর ১লা জুলাই ভারতে চিকিৎসক দিবস (Doctors Day in India) পালন করা হয়। বিশেষভাবে এই দিনটিকে বেছে নেওয়ার নেপথ্যে রয়েছেন, ডঃ বিধান চন্দ্র রায় (Dr Bidhan Chandra Roy)! বিধান চন্দ্র রায় শুধু একজন সফল ডাক্তারই নন। তিনি এক বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনের গল্প। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের জীবন যে কোনও মানুষকে হেরে গিয়ে ফিরে আসা শেখায়।
ভগবান সমতুল্য মনে করা হয় চিকিৎসকদের। তাদের হাত ধরে যেমন পৃথিবীতে আসতে পারে প্রাণ, তেমনি তাদের হাতে হতে পারে মৃত্যুও। আবার মৃত্যুর মুখ থেকে রোগীকে ফিরেও আনতে পারেন এই চিকিৎসকরা। ঈশ্বরতুল্য এই চিকিৎসকদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্যই প্রতিবছর ১লা জুলাই ভারতে চিকিৎসক দিবস (Doctors Day in India) পালন করা হয়ে থাকে। তবে বিশেষভাবে এই দিনটিকে বেছে নেওয়ার নেপথ্যে রয়েছে বড় কারণ , ডঃ বিধান চন্দ্র রায় (Dr Bidhan Chandra Roy)! তাঁর জন্ম উপলক্ষে পালন করা হয় এই দিনটি।
জাতীয় চিকিৎসক দিবসের ইতিহাস । History of National Doctor's Day :
১৮৮২ সালের ১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ডঃ বিধান চন্দ্র রায় (Bidhan Chandra Roy)। তিনি শুধু একজন বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন তা নয়, পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। মানুষের সেবায় নিজের সারা জীবন নিয়োজিত করেছিলেন বিধান চন্দ্র রায়। ফলত এই মানুষটির স্মরণে ১৯৯১ সাল থেকে বিধান চন্দ্র রায়ের জন্মদিন উপলক্ষে ১লা জুলাই ভারতে চিকিৎসক দিবস (Doctors Day in India) পালন করা হয়।
যে ব্যক্তিরা স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে নিজেদের নিয়োজিত করে থাকেন এবং নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পিছু পা হন না, সেই মানুষগুলিকে সম্মান দেওয়াই হল জাতীয় ডাক্তার দিবস উদযাপনের একমাত্র তাৎপর্য। এদিন বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা, হাসপাতাল ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও কর্মসূচি ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এই দিন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অবদান রাখা চিকিৎসকদের সম্মান জানানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয় এই দিন। বিশ্বের সমস্ত চিকিৎসকদের সম্মান দেওয়াই প্রত্যেক মানুষের প্রধান কর্তব্য। প্রসঙ্গত, চিকিৎসকরা ঈশ্বরতুল্য হলেও সকলকেই মনে রাখতে হবে, চিকিৎসকরা দিনের শেষে একজন মানুষই। তাঁরা চেষ্টা করতে পারেন রোগীকে সুস্থ্য করার বা প্রাণ রক্ষার জন্য কিন্তু সবটুকু যে তাঁদের হাতে নেই।
ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের জীবনী । Biography of Dr. Bidhan Chandra Roy :
বিধান চন্দ্র রায় (Bidhan Chandra Roy) ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে আমৃত্যু তিনি সেই পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। এছাড়া চিকিৎসক হিসেবেও তিনি বিশেষ খ্যাতিও অর্জন করেছিলেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ড থেকে এম আর সি পি (MRCP) এবং এফ আর সি এস (FRCS) উপাধি অর্জন করার পর কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলে অর্থাৎ বর্তমানে যেটা নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ, সেখানে শিক্ষকতা করেন এবং পাশাপাশি চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য রয়াল সোসাইটি অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন এন্ড হাইজিন এবং আমেরিকান সোসাইটি অফ চেস্ট ফিজিশিয়ান এর ফেলো নির্বাচিত হন। বিধান চন্দ্র রায় পাঁচটি নতুন শহরের প্রতিষ্ঠা করেন, বিধাননগর (সল্টলেক), দুর্গাপুর, অশোকনগর-কল্যাণগড়, কল্যাণী ও হাবড়া। এছাড়া ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে বিধানচন্দ্র রায় ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্নে ভূষিত হন।
বিধান চন্দ্র রায়ের জন্ম-পরিবার :
ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের পরিবারের আদি নিবাস ২৪ পরগনা জেলার টাকি, শ্রীপুরে। কিন্তু বিধান চন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁর পিতার কর্মস্থল বিহারের পাটনাতে। বিধানচন্দ্র রায়ের পিতা প্রকাশ চন্দ্র রায় ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং মাতা অঘোর কামিনী দেবী।
বিধান চন্দ্র রায়ের শিক্ষা ও কর্মজীবন :
বিধান চন্দ্র রায় ছিলেন খুবই শিক্ষিত। তখনকার সময় চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করার জন্য বিধানচন্দ্র রায় কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এল এম এস এবং ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.ডি. উপাধি লাভ করে তারপর পরবর্তীতে প্রাদেশিক মেডিকেল সার্ভিসে যোগ দেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে বিধানচন্দ্র রায় বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন এবং ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সেখানে দুই বছর থেকে এম আর সিপি (MRCP) এবং এম আর সি এস (MRCS) ও পরবর্তীতে FRCS উপাধি অর্জন করেন। খুবই কম সময়ের মধ্যেই শুধু চিকিৎসক রূপে তিনি খ্যাতি অর্জন করে ফেলেন। সাথে সাথে দেশের সমাজ জীবনের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল খুবই ভালো। তিনি সমাজ সেবামূলক কাজ করতে খুবই পছন্দ করতেন।
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বিধানচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হন। দুই বছর পর ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বিধানচন্দ্র রায় ক্যাম্বেলের সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন, তার পরিবর্তে যোগদান করেন কারমাইকেল মেডিকেল কলেজে। মেডিসিনের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন, বর্তমান যেটা আরজিকর মেডিকেলে। কলেজের নাম তখন ছিল কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ, এখানে কর্মরত অবস্থাতেই বিধানচন্দ্র রায় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।
রাজনীতিতে বিধানচন্দ্র রায় :
বাংলা তথা ভারতের জননেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এর প্রভাবে বিধান চন্দ্র রায় (Bidhan Chandra Roy)রাজনীতিতে যোগদান করেন ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর স্বরাজ দলের হয়ে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিধানচন্দ্র বাংলার ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ডঃ বিধান চন্দ্র রায় (Dr Bidhan Chandra Roy) বাংলার পার্লামেন্টারি কমিটির সভাপতি হন এবং কংগ্রেসের নির্বাচন পরিচালনা করেন। দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে ক্রমশই বিধান চন্দ্রের প্রভাব এবং গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর বিধানচন্দ্র রায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি এস সি (DSC) উপাধিতে ভূষিত করে। এছাড়াও তিনি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৩১ থেকে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হয়েছিলেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিধানচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থী রুপে আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ২৩ শে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন বিধান চন্দ্র রায় । মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন তিনি।
শিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর জন্য বিধানচন্দ্র রায় বিভিন্ন ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতেন। রাজ্যের চটকলগুলির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল অর্থাৎ পাট-এর বিষয়ে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতে লাগলেন। তবে দেশ বিভাগের ফলে পূর্ব বাংলা হয়ে গেল ভিন্ন একটি দেশ, এর ফলে রাজ্যের চট শিল্পে দেখা দিয়েছিল খুবই সংকটময় অবস্থা। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য বিধানচন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপকভাবে পাট চাষের বন্দোবস্ত করতে লাগলেন। তিনি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- বর্ধমান, কল্যাণী, উত্তরবঙ্গ ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। এছাড়া অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্যান্ডেল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের বিভিন্ন প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও বিধান নগর উপনগরী, রাষ্ট্রীয় পরিবহন, কল্যাণী উপনগরী, হরিণঘাটা, দুগ্ধ প্রকল্প এই সব কিছুর উদ্যোক্তা ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। বিধানচন্দ্র রায়ের ১৪ বছরের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা কালীন নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উন্নতি সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র তাঁর কারণেই, আর সেই জন্যই তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের রূপকার নামে অভিহিত করা হয়।
বিধান চন্দ্র রায়ের মৃত্যু:
এমন একটি প্রতিভাশালী ব্যক্তির মৃত্যুতে সকলে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ১ লা জুলাই কর্মরত অবস্থাতে কলকাতার রাজভবনে, আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের রূপকার, দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায় তাঁর গুরুদায়িত্ব পালন করতে থাকা অবস্থাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ডঃ বিধান চন্দ্র রায় (Dr Bidhan Chandra Roy) শুধু একজন সফল ডাক্তারই নন। তিনি এক বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনের গল্প। এ গল্প যেন সিনেমাকেও হার মানায়। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের জীবন যে কোনও মানুষকে হেরে গিয়ে ফিরে আসা শেখায়। শেখায় বাঁচতে, শেখায় অদম্য অটল হয়ে জীবনের প্রতি বিশ্বাস রাখতে। চিকিৎসক হিসেবে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি। যার ফলে তাঁর জন্মদিবসের দিনই ভারতে পালন করা হয় জাতীয় চিকিৎসক দিবস।