ডায়াবেটিস | Diabetes

Thursday, May 12 2022, 1:14 pm
highlightKey Highlights

ডায়াবেটিসের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার, ডায়াবেটিস প্রকারভেদ, চিকিৎসা, ঔষধের নাম, ডায়াবেটিসের কারণ, লক্ষণ, ডায়াবেটিস কি খেলে ভালো হয়।


ভূমিকা | Introduction of Diabetes

একটি সাধারণ অন্তঃস্রাব মূলক রোগ ডায়াবেটিস, পুরুষ- মহিলা নির্বিশেষে যেকোনো মানুষের যেকোনো বয়সেই হতে পারে।  হরমোন সংশ্লিষ্ট এই রোগটি বহুমূত্র রোগ, মধুমেহ বা  ইংরেজিতে  ডায়াবেটিস মেলিটাস হিসেবে পরিচিত।  রক্তে শর্করা বা চিনির মাত্রা অত্যধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেলে  বা অসামঞ্জস্যতা দেখা দিলে  যে পরিস্থিতিগুলি তৈরী হয় এক কথায় তাকেই আমরা ডায়বেটিস বলে অভিহিত করে থাকি। মানবদেহের অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট ইনসুলিন উৎপাদন করতে না পারে অথবা শরীর যদি উৎপন্ন ইনসুলিন ব্যবহার করতে অক্ষম হয় তবে সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইনসুলিনের সাহায্যে  দেহের কোষগুলো রক্ত থেকে গ্লুকোজ গ্রহণ করতে  সমর্থ হয় কিন্তু এই প্রক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে  যার ফলস্বরূপ শরীরের বাড়তে পারে জটিলতা এবং দেহের বিভিন্ন যন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।  

ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ 
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ 

 এই বিশ্বে  ডায়াবেটিস বা মধুমেহ একটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া মহামারি বলা যায়। ভারতবর্ষে প্রায় ৭৩ মিলিয়ন এই রোগে আক্রান্ত এবং সঠিক সময়ে যদি এই রোগের চিকিৎসা না করা হয় তাহলে এর ফল ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতম হতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ডায়বেটিসের মধ্যে  প্রধানত 'টাইপ ওয়ান' এবং 'টাইপ টু'  ডায়াবেটিসের প্রকোপ মানুষের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায়। ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীল টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস শিশুদের কিম্বা তিরিশ বছরের কম বয়সী মানুষদের হতে পারে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে পৃথিবীর ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে   প্রায় দশ শতাংশ ই  টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস ভুক্ত রোগী।

১)জুভেনাইল ডায়াবেটিস এবং ২)লাভা-  টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের দুটি বিশেষ প্রকার হিসেবে গণ্য করা হয়।সব থেকে সাধারণ এবং প্রধানতম ডায়াবেটিস হলো টাইপ টু ডায়বেটিস যা প্রকট হয় যখন শরীর প্রয়োজনের তুলনায় কম ইনসুলিন উৎপাদন করে। এ ধরনের ডায়াবেটিস মূলত  একটি বংশগত প্রবৃত্তি এবং এটি অল্পবয়সী শিশুদের মধ্যে ও সংঘটিত হতে পারে । অপ্রতুল শারীরিক পরিশ্রম ,মানসিক চাপ ,কু খাদ্যাভ্যাস এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনধারার কারণে এই টাইপ টু ডায়াবেটিস আজ সারা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান। 

ডায়াবেটিসের উপসর্গ | Symptoms of diabetes

মানব শরীরে ডায়াবেটিস বা মধুমেহ সংক্রমণ হয়েছে কিনা তার সংকেত  কিছু শারীরিক লক্ষণ  এবং উপসর্গের মাধ্যমে সহজেই চিহ্নিত করা যায়।তবে বর্তমান চিকিত্সাশাস্ত্র প্রভূত উন্নত হওয়ার কারণে  প্রাথমিক স্তরে এই রোগ ধরা পড়ে এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এটি কে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর।  

ডায়াবেটিসের উপসর্গ
ডায়াবেটিসের উপসর্গ

ডায়াবেটিস রোগীর প্রাথমিক লক্ষণগুলি হল :

  1. আকস্মিক তীব্র ক্ষুধা ও সর্বদা তৃষ্ণার্ত থাকা, 
  2. বিনা কারণবশত ওজন কমে যাওয়া ,
  3. স্বাভাবিকের থেকে অধিকবার প্রস্রাবের বেগ এবং তা বিশেষ করে রাতের বেলায় বৃদ্ধি পাওয়া,
  4. সহজেই ক্লান্তি বোধ করা ও দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা ,
  5. সংক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া বিশেষ করে মাড়ি ত্বক এবং ব্লাডারে।
  6. ক্ষত উপশম হতে প্রয়োজনের থেকে বেশি সময় লাগা,
  7. মেজাজের তারতম্য ঘটা বা খিটখিটে মেজাজ হয়ে যাওয়া,*হাতের তালুতে বা পায়ের পাতায় জ্বালা ধরা,
  8. পুরুষের যৌন সমস্যা,
  9.  অতিশয় দুর্বল বোধ করা।

রোগের প্রাথমিক নির্ণয় | Early diagnosis

মানবদেহে প্রাথমিক পর্যায়ে  যদি ডায়াবেটিসের উপরিউক্ত উপসর্গগুলো চিহ্নিত ও নির্ণয়  করা যায় তবে ডাক্তারের পরামর্শ  অনুযায়ী চললে ও প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ মানলে এই রোগ থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হবে।

প্রাথমিক পর্যায়ে  ডায়াবেটিস শনাক্ত করার জন্য সবচেয়ে সঠিক এবং সর্বাধিক  ব্যবহৃত পদ্ধতি হলো ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স পরীক্ষা   বা ওজিটিটি। এই পরীক্ষার পদ্ধতি অনুযায়ী  রোগীর সকালে খালি পেটে একবার রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা করা হয়ে থাকে এবং তারপর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ শরবত পানের দুই ঘণ্টা পর পুনরায়  রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা করা হয়। এই পদ্ধতিতে সঠিক ও নির্ভুল ভাবে  ডায়াবেটিস ও প্রি-ডায়াবেটিস রোগের নির্ণয় করা সম্ভব। তবে এই পরীক্ষায় অনেক জটিলতা থাকায় রোগীদের মধ্যে একটি প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তবে ইদানীং  বিজ্ঞানীরা সহজতর পদ্ধতি অবলম্বন করে  ডায়াবেটিস শনাক্তকরণের জন্য এইচবিএ১সি নামের পরীক্ষা চালু করেন যা রক্তে শর্করার কয়েক মাসের গড় নির্দেশ করে থাকে। এই পরীক্ষাটি দিনের যেকোনো সময়তেই রোগীর সুবিধে অনুযায়ী করা যায়  এবং রক্তের নমুনা একবারই দিলেই তা কার্যকরী হয়।

Early diagnosis of diabetes
Early diagnosis of diabetes

আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের পরামর্শ অনুসারে এইচবিএ১সির মান ৫.৭-এর নিচে থাকলে তাকে স্বাভাবিক বলে ধার্য করা হয়ে থাকে এবং  ৬.৫-এর বেশি হলে ডায়াবেটিস রোগের উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। অর এই মান  যদি ৫.৭ থেকে ৬.৫-এর মধ্যে থাকে তাহলে প্রি-ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থা হিসেবে  ধার্য করা হয়।

তবে খেয়াল রাখতে হবে যে এইচবিএ১সি পরীক্ষা যে কোনো উন্নত মানের ল্যাবরেটরিতে ও নির্দেশিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। তবে বংশগত রক্তরোগের সমস্যা থাকলে এই পরীক্ষা নির্ভুল প্রমাণিত নাও হতে পারে এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা উপযুক্ত হিসেবে ধরা হয় না। অন্যদিকে, চল্লিশোর্ধ্ব  মানুষের যদি ওজন বৃদ্ধি পায়, ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস ও অন্যান্য ঝুঁকি থেকে থাকলে নিয়মিতভাবে ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং করা উচিত যার জন্য  ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট বা এইচবিএ১সি পরীক্ষা করার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে ।

ডায়াবেটিসের চিকিৎসা | Treatment of diabetes

ডায়াবেটিসের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যা করণীয় তা হল  রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ বা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাখা। তবে ডায়াবেটিসজনিত কোনো জটিলতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকলে  তার যথোপযুক্ত চিকিৎসা করা দরকার। তবে রোগের তীব্রতা অনুযায়ী  ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য চিকিৎসা পদ্ধতির তারতম্য হতে পারে। কিন্তু সকল ডায়াবেটিক রোগীর জন্য মূলনীতি প্রায় একই রকম । সেগুলো হলো–

শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম (Physical activity or exercise)

মধুমেহ বা ডায়বেটিস রোগের নিরাময়ে প্রথম ধাপ হল নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করা। তবে যেসব রোগীদের পক্ষে ব্যায়াম করা সম্ভব না তাদের পক্ষে হাঁটা একটি অন্যতম উৎকৃষ্ট উপায়।     সকাল-বিকেল, সন্ধ্যা বা রাতে যে কোনো সময়ই হাঁটতে পারা যেতে পারে। সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন হাঁটতে পারলে এবং  হাঁটার গতি প্রতি ৪০ মিনিটে ৩ মাইল হলে উপকার পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া  সাঁতার বা জগিং করাও এই রোগের পক্ষে খুব উপকারী সাব্যস্ত হয়ে থাকে।

Physical activity
Physical activity

নিয়মিত ওষুধ সেবন (Take medication regularly)

খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, ব্যায়াম এবং শারীরিক শ্রম যখন রক্তে  কাঙ্ক্ষিত মাত্রার গ্লুকোজ আনতে সক্ষম হয় না তখন ওষুধ সেবন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায় । এ ক্ষেত্রে ওষুধ দু’ধরনের - অ্যান্টি ডায়াবেটিক খাবার ওষুধ ও ইনসুলিন। রোগের তীব্রতা অনুসারে ডাক্তার ওষুধের পরিমাণ ও ধরণ নির্ধারণ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শেই সর্বশেষ কথা।

নিয়মিত ওষুধ সেবন
নিয়মিত ওষুধ সেবন

টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের চিকিৎসা (Treatment of type 1 diabetes)

এ ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিতে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বিভিন্ন ব্যবধানে মাপা হয়। গ্লুকোজের মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োজন সাপেক্ষে ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়া হয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে   এ ধরনের জুভেনাইল ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস এবং পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম ই এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়ে থাকে।  

টাইপ টু ডায়াবেটিসের চিকিৎসা (Treatment of type 2 diabetes)

প্রাথমিক স্তরে এই ডায়াবেটিস ধরা পড়লে রোগীকে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করতে হয় নিজের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করার। এছাড়া নিয়মিত শরীরচর্চা, সাইকেল চালানো, ব্যায়াম প্রভৃতি এই রোগকে প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে যা ডাক্তারেরা ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন রোগীদের। টাইপ টু ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে রোগ পুরোনো হলে রোগীকে ইনসুলিন এর সাহায্য নিতে হতে পারে। তবে নিয়মিত  ব্যবধানে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ মাপাও বাধ্যতামূলক।

খাদ্য গ্রহণে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অসুখ সম্বন্ধে রোগীর সঠিক ধারণা | Increased awareness of food intake and the patient's correct perception of the disease

ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ 
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ 

পর্যাপ্ত পরিমাণে  সঠিক খাদ্যাভ্যাস ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে পারে। প্রতিদিন অল্প পরিমাণে বারে বারে (অন্ততপক্ষে ছয়বার) হালকা খাদ্যগ্রহণ করা এ ক্ষেত্রে খুব উপকারী। চিনি বা শর্করাযুক্ত খাবার কম গ্রহণ করে  ফাইবার যুক্ত খাদ্য নিয়মিত খেলে তা  ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে 'অক্সিজেন' নেওয়ার সমতুল্য হিসেবে গণ্য করা হয়। তাছাড়া মধুমেহ রোগ সম্পর্কে রোগীর সম্যক ধারণা থাকাটাও এই ক্ষেত্রে আবশ্যক।চিকিৎসকের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র সুষ্ঠভাবে মেনে চলে শরীরে পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা বজায় রাখতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ভিন্ন কোনো কারণেই এই রোগের চিকিৎসা বন্ধ রাখা যাবে না। প্রয়োজন অনুসারে রোগী শর্করা পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে নিজেই রক্তে শর্করা পরিমাপ করে এই রোগটি কে  নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। 

উপসংহার | Conclusion

২০০৬ সালের, ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটি  ঘোষণার মাধ্যমে  ডায়াবেটিসকে একটি  দীর্ঘমেয়াদি, অবক্ষয়ী ও ব্যয়বহুল ব্যাধি হিসাবে বর্ণনা করেছে যা মানব শরীরে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।  তবে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা নিলে এই রোগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ব্যবস্থাগুলো রোগীকে সঠিক রূপে মানতে হবে এবং রোগীর পরিবারের  সদস্যদের সহযোগিতা এ ব্যাপারে আবশ্যিক। তাই এ রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য  সুচিকিৎসার সাথে সাথে , রোগীর প্রয়োজনীয় সচেতনতা এবং  রোগীর নিকটাত্মীয়দেরও এই রোগ সম্পর্কে যথাযথ  জ্ঞান থাকা দরকার যা এই রোগ থেকে একমাত্র মুক্তির পথ।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File