হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ,কারণ এবং তার প্রতিকার, A detailed study about Hypothyroidism  in Bengali

Saturday, August 6 2022, 8:06 pm
highlightKey Highlights

হাইপোথাইরয়েডিজম হল মানুষ এবং পশুর একটি রোগ, যা থাইরয়েড গ্রন্থি হতে উৎপাদিত থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদনে স্বল্পতা দেখা দেওয়ার কারণে হয়ে থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে থাইরয়েড হরমোনের জন্মগত অভাবজনিত কারণে বামনত্ব, পেশীকাঠিন্য ও মানসিক জড়তা হলে তাকে ক্রেটিনিজম বলা হয়।


হাইপোথাইরয়েডিজমের প্রধান কারণ?Main cause of Hypothyroidism

থাইরয়েড হরমোন তৈরীতে আয়োডিন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং সারা বিশ্বের পরিসংখ্যানে আয়োডিনের অভাবই হাইপোথাইরয়েডিজমের সর্বপ্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত।

Trending Updates

দেহে আয়োডিনের অভাব দূর করা কঠিন কাজ নয়, অথচ বর্তমানে এই কারণের প্রকোপই পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ শিশুদের মধ্যে শারীরিক সমস্যা ও মানসিক জড়তা ঘটিয়ে চলেছে। আয়োডিনের অভাব হওয়া হাইপোথাইরয়েডিজমের প্রধান কারণ হলেও এটি একমাত্র কারণ নয়; বিভিন্ন কারণে থাইরয়েড গ্রন্থিতে হরমোন উৎপাদনের অভাব দেখা দিতে পারে, যার পরিণাম কখনও সাময়িক হয় আবার কখনও স্থায়ী হতে পারে।

যেমন বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে হাইপারথাইরয়েডিজমের চিকিৎসা করার সময় তেজস্ক্রীয় আয়োডিন-১৩১ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে যা থাইরয়েড গ্রন্থিতে জমা হয় এবং তা থাইরয়েড গ্রন্থির তীব্র ক্ষতি করে, যার স্থায়ী ফলস্বরূপ আয়াট্রোজেনিক হাইপোথাইরয়েডিজম (অর্থাৎ ঔষধজনিত বা চিকিৎসাঘটিত) ঘটে; যার কারণে প্রায় সারা জীবন এসব রোগীদের থাইরয়েড হরমোন ওষুধ হিসাবে খেয়ে যেতে হয়।

হাইপোথাইরয়েডিজমের বিভিন্ন কারণ, Various other causes of Hypothyroidism

বিশ্বের সাধারণ জনসংখ্যার প্রায় তিন শতাংশই হাইপোথাইরয়েডের সমস্যায় আক্রান্ত। হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত হওয়ার বেশকিছু কারণ রয়েছে।

● আয়োডিনের স্বল্পতা ছাড়াও বিভিন্ন কারণ, যেমন - হাশিমোতোর থাইরয়েডিটিস বা থাইরয়েড গ্রন্থির এক প্রকারের প্রদাহ ঘটা (ইনফ্ল্যামেশন), অথবা হাইপোথ্যালামাস বা পিটুইটারি গ্রন্থির হতে নিসৃত থাইরয়েড স্টিম্যুলেটিং হরমোনের স্বল্পতাও এই রোগ সৃষ্টির কারণ হতে পারে।

● মহিলাদের গর্ভধারণের সময়কলে দেহের মেটাবলিজম বৃদ্ধির ফলে থাইরয়েড হরমোনের প্রয়োজন অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায় বলে সাময়িক ভাবে দেহে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কম হয়ে যেতে পারে যা জন্মদানের পর হয়তো আপনা আপনি ঠিক হয়ে যেতে পারে; তবে কারো ক্ষেত্রে যদি আগে থেকেই মৃদু হাইপোথাইরয়েডিজমের সমস্যা থাকে তাহলে তা আরো প্রকট হয়ে উঠতে পারে।

● এছাড়াও পোস্টপার্টাম থাইরয়েডিটিজ থেকেও হাইপোথাইরয়েডিজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সন্তান জন্ম দেওয়ার পর এক বছরের মধ্যেই প্রায় পাঁচ শতাংশ মহিলা পোস্টপার্টাম (অর্থাৎ জন্মদান পরবর্তী) থাইরয়েডিটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। থাইরয়ডাইটিসের প্রথম দশায় মহিলাদের থাইরয়েড গ্রন্থি হতে খুব বেশি বেগে হরমোন নিসৃত হয় যার ফলে হাইপারথাইরয়েডিজম দেখা দিতে পারে। সাধারণত যে সকল মহিলা পোস্টপার্টাম থাইরয়েডিটিজের সমস্যা দ্বারা হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, তাদের ক্ষেত্রে গড়ে পাঁচ জনের মধ্যে একজনের স্থায়ী হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং বাকি জীবন তাদের এই রোগের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

● অস্থায়ী হাইপোথাইরয়েডিজম রোগের আরেকটি বিশেষ কারণ হতে পারে 'ওলফ-চেইকোফ ইফেক্ট', এক্ষেত্রে খুব বেশি আয়োডিনের প্রভাবে আমাদের থাইরয়েড গ্রন্থির মধ্যে থাইরোগ্লোব্যুলিনের সাথে আয়োডিনের সংযোগ হবার (আয়োডিন আত্তিকরণ) ধাপে অসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে।

দেহের যেসকল প্রত্যঙ্গ হতে রোগ উৎপন্ন হয় তার ওপর ভিত্তি করে হাইপোথাইরয়েডিজমকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়:

● থাইরয়েড গ্রন্থি : সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো হাশিমোতোর থাইরয়েডিটিস (একটি অটোইমিউন রোগ) এবং হাইপারথাইরয়েডিজমের জন্য রেডিওআয়োডিন থেরাপি।

● পিটুইটারি গ্রন্থি : যখন দেহের পিটুইটারি গ্রন্থি পর্যাপ্ত পরিমাণ থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন (TSH) উৎপন্ন করতে ব্যর্থ হয়, যা থাইরয়েড গ্রন্থিকে প্রয়োজনীয় থাইরক্সিন ও ট্রাইআয়োডোথাইরোনিন উৎপন্ন করতে সাহায্য করে। যদিও সেকেন্ডারি হাইপোথাইরয়েডিজমের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই, তবুও সাধারণত টিউমার, রেডিয়েশন বা শল্যচিকিৎসার কারণে পিটুইটারি গ্রন্থি কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেকেন্ডারি হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে।

● হাইপোথ্যালামাস : এটা ঘটে যখন হাইপোথ্যালামাস পর্যাপ্ত পরিমাণ থাইরোট্রপিন রিলিজিং হরমোন (TRH) উৎপন্ন করতে ব্যর্থ হয়। পিটুইটারি থাইরোট্রপিন (TSH) উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। এটাকে হাইপোথ্যালামিক-পিটুইটারি-অ্যাক্সিস-হাইপোথাইরয়েডিজম বলে।

রোগের লক্ষণ, Symptoms

প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে হাইপোথাইরয়েডিজমের নিম্নে উল্লেখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়।

প্রাথমিক লক্ষণ

● ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পারা, ঠাণ্ডার প্রতি স্পর্শকাতরতা বৃদ্ধি পায়।
● ওজনবৃদ্ধি, এমনকি কম খেলেও।
● শরীরে আন্তঃকোষীয় কলা বৃদ্ধি ও পানি জমা শুরু।
● ব্রাডিকার্ডিয়া (নাড়ির গতি হ্রাস পাওয়া—স্পন্দন মিনিটে ষাট বারেরও কম হয়)
● ঘামের পরিমাণ হ্রাস পাওয়া।

● ত্বকের শুষ্কতা ও চুলকানি প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া
● পেশিতে হালকা ব্যাথা বা ক্রাম্প - প্রধানতঃ পেশির হাইপোটোনিয়া বা শৈথিল্যের কারণে।
● দৈহিক অবসাদ বা অস্বস্তি এবং সারা দেহে এবং অস্থিসন্ধিতে (অর্থাৎ গাঁটে) ব্যাথা ।
● বিষণ্ণতা বা মানসিক অবসাদগ্রস্থতা যাকে সিউডো-ডিপ্রেশন বলা হয়।
● গলগণ্ড থাকতে পারে, বা নাও থাকতে পারে।
● চিকন, ভঙ্গুর আঙ্গুলের নখ।
● চিকন, ভঙ্গুর চুল, বেশি চুল পড়া ।
● মলিনতা।
● কোষ্ঠকাঠিন্য।
● রজঃস্রাব প্রাথমিক দশায় বৃদ্ধি পেতে পারে।

বিলম্বিত লক্ষণ

● শরীরে আন্তঃকোষীয় কলা বৃদ্ধি ও জল জমার জন্য এমনকি কার্পাল টানেল সিনড্রোম পর্যন্ত হতে পারে।
● ত্বক শুষ্ক এবং ফুলে যায়, বিশেষ করে মুখ
● স্বরতন্ত্রীর স্ফীতির জন্য স্বর ভেঙে গিয়ে ভারি হয়ে যায়।
● চিন্তাধারার গতি স্লথ হয়ে যায়।
● দুই কারণেই কথা ধীরে ধীরে বলতে হয়।
● চোখের ভ্রু চিকন হতে শুরু করে এবং ভ্রুর বাইরের অংশ প্রায় মুছে যায় (ম্যাডারোসিস)।
● রজঃচক্র অনিয়মিত হয়ে পড়ে।
● শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস পায়।

বিরল লক্ষণসমূহ

● স্মৃতি শক্তির অবক্ষয়
● অমনোযোগ
● ধীরতর হৃৎস্পন্দন
● টাক পড়া
● ত্বক বাদামী হওয়া
● ধীর স্নায়বিক রিফ্লেক্স
● গলধঃকরণের সমস্যা
● অস্থির মেজাজ
● যৌনউত্তেজনার হ্রাস
● ঘ্রাণশক্তির হ্রাস
● মিক্সিডিমা কোমা

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা বেশি দেখা যায় তা হল:

● হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া
● কোষ্ঠকাঠিন্য
● অতিনিদ্রা
● দুর্বল খাদ্যভ্যাস

রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষা কি কি, How to detect Hypothyroidism

এই রোগ নির্ণয়ের প্রাথমিক ক্ষেত্রে বা প্রাইমারি হাইপোথাইরয়েডিজম নির্ণয়ে বেশিরভাগ ডাক্তার সাধারণত পিউটুইটারি গ্রন্থি হতে উৎপন্ন থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোনের (TSH) পরিমাণ পরিমাপ করে থাকেন।

TSH উচ্চমাত্রায় হওয়া এই নির্দেশ দেয় যে থাইরয়েড গ্রন্থি যথেষ্ট পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন করতে অক্ষম, প্রধানত থাইরক্সিন হরমোন (T4)।

কিন্তু সেকেন্ডারি এবং টারশিয়ারি হাইপোথাইরয়েডিজম রোগটি TSH পরিমাপের দ্বারা নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। তবে TSH এর পরিমাণ স্বাভাবিক থাকলেও হাইপোথাইরয়েডিজম নির্ণয় করা যায় এবং সেক্ষেত্রে যেসব রক্ত পরীক্ষাগুলো করানোর পরামর্শ দেওয়া হয় সেগুলো হলো:

● মুক্ত ট্রাইআয়োডোথাইরোনিন (free T3)
● মুক্ত থাইরক্সিন (free T4)
● সমস্ত (অর্থাৎ মুক্ত ও প্রোটিনে যুক্ত) ট্রাইআয়োডোথাইরোনিন (Total T3)
● সমস্ত (অর্থাৎ মুক্ত ও প্রোটিনে যুক্ত) থাইরক্সিন (Total T4)
এছাড়াও অন্যান্য বিশেষ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।

হাইপোথাইরয়েডিজম এর চিকিৎসা, Hypothyroid Treatment

হাইপোথাইরয়েডিজমের কোনও স্থায়ী চিকিৎসা নেই বললেই চলে; তবে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী  ঔষধের দ্বারা এই রোগের লক্ষণ গুলো প্রশমিত করা যায় । তবে হাইপোথাইরয়েডিজম রোগীর  ওষুধের পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী যে সব খাবার খাওয়া উচিত সেগুলো হল:

● হাইপোথাইরয়েডিজম যদি আয়োডিনের অভাবে ঘটে থাকে সেক্ষেত্রে প্রতিদিন কিছু না কিছু আয়োডিন জাতীয় খাবার, যেমন – লবণাক্ত জলের মাছ, ডিম,এবং দুগ্ধজাতীয়  পণ্য  খাওয়া জরুরি। তাছাড়া এখন বাজারে আয়োডিন যুক্ত লবন পাওয়া যায় , যা দামে কম এবং সহজলভ্য, খাবারে তা ব্যবহার করা যায় ।

● সেলেনিয়াম দেহের থাইরয়েড হরমোনগুলোকে সক্রিয় রাখতে সহায়তা করে । তাই নিত্যদিনের  খাদ্যতালিকায় সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ খাবার (যেমন টুনা মাছ, ডিম এবং লেবু )যুক্ত করা দরকার ।

● জিঙ্ক থাইরয়েড হরমোনকে সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে । খাবারে জিঙ্কের উৎস স্বরূপ ঝিনুক, শুয়োরের মাংস, বাদাম, মুরগী মাংস, মসুর ডাল, দই এবং মাশরুম রাখা যেতে পারে।

উপসংহার, Conclusion

যেহেতু হাইপোথাইরয়েডিজম রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সম্পূর্ণ সুস্থতা লাভ করা প্রায় অসম্ভব, সেহেতু একজন চিকিৎসকের কাছে এ রোগ সম্পর্কে পরামর্শ নিয়ে দেহে থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে সুস্থ থাকার উপায়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File