Success Story of Godrej | ভেঙে গেল ১২৭ বছরের গোদরেজ পরিবার! জানেন কীভাবে ব্রিটিশ আমলে তালা ব্যবসা থেকে শুরু বর্তমানে অন্যতম সফল সংস্থায় পরিণত হলো গোদরেজ?

Friday, May 3 2024, 12:20 pm
highlightKey Highlights

দেশের প্রাচীনতম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করেন আর্দেশির গোদরেজ। স্বাধীনতার আগে যাত্রা শুরু করে এই কোম্পানি। বর্তমানে গোদরেজের মোট সম্পত্তির মূল্য ২.৩৪ লাখ কোটি টাকা। তবে ভেঙে গিয়েছে ১২৭ বছরের গোদরেজ পরিবার। গোদরেজ গ্রুপের সদস্যরা সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপাতত দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে গোদরেজ পরিবার।


ভেঙে গিয়েছে ১২৭ বছরের গোদরেজ পরিবার। গোদরেজ গ্রুপের সদস্যরা সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপাতত দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে গোদরেজ পরিবার। একদিকে আদি গোদরেজ ও তাঁর ভাই নাদির গোদরেজ (Nadir Godrej) এবং অন্যদিকে তাঁদের খুড়তুতো ভাই জামশেদ গোদরেজ এবং স্মিতা গোদরেজ কৃষ্ণা। বলে রাখা ভালো, গোদরেজের মোট সম্পত্তির মূল্য ২.৩৪ লাখ কোটি টাকা। স্বাধীনতার আগে যাত্রা শুরু করে এই কোম্পানি। দেশের প্রাচীনতম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করেন আর্দেশির গোদরেজ (Ardeshir Godrej)। বর্তমানে প্রত্যেক ভারতীয়র ঘরে গোদরেজ কোম্পানির কোনো না কোনো আসবাব পাওয়া যায়। নয় গোদরেজ আলমারি (godrej almirah), না হয় গোদরেজ ফ্রিজ (godrej fridge) বা গোদরেজ লকার (godrej locker)। তবে জানেন কীভাবে চালু হলো এই কোম্পানি? কীভাবেই বা তালা বানানো থেকে শুরু করে অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাব বানাতে শুরু করে গোদরেজ?

 ভারতে গোদরেজ সংস্থার সুপ্রাচীন ইতিহাস!

Trending Updates

গোদরেজ সংস্থার যাত্রা শুরু হয়েছেইল ১৮৯৭ সালে। তখন সদ্য প্রকাশিত হয়েছে তরুণ রবীন্দ্রনাথের কাব্য চিত্রা, চৈতালী। জমাট বাঁধছে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতের জন-আন্দোলন। ঠিক এইরকম সময় এক পার্সি ব্যবসায়ী আর্দেশির গোদরেজ (Ardeshir Godrej) একটা তালা বানানোর কারখানা তৈরি করেন।

তৎকালীন সময়ে তালা আমদানি হত বাইরে থেকে। ওইরকম সময় আর্দেশির গোদরেজের কারখানাতেই বলা চলে, প্রথমবার তৈরি হয় দেশি প্রযুক্তির হাতে বানানো তালা। এটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় ১৯০৮ সালে, যখন গোদরেজ পৃথিবীর প্রথম স্প্রিং-ছাড়া তালার পেটেন্ট আদায় করে নেয়। এই ঘটনার তিন বছর পর ভারত সফরে আসেন ব্রিটেনের মহারাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি। সেই ব্রিটিশ আমলেও তাঁদের বহুমূল্য নানা ধনদৌলত সেবার রাখা হয়েছিল গোদরেজ লকার (godrej locker) বা সিন্দুকে। ক্রমেই গোদরেজের তালা পায় নতুন এক পরিচয়।

গোদরেজের সিন্দুক কতখানি মজবুত, তার একটা প্রমাণ মিলেছিল ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল। সেই সময় ক্রমশ ঝিমিয়ে আসছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ইউরোপের রণাঙ্গনে মোটের ওপর মিত্রবাহিনী দখল নেয়। করাচি থেকে বোম্বাইয়ের তৎকালীন ভিক্টোরিয়া ডকে এসে নোঙর ফেলে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ 'এসএস ফোর্ট স্টাইকিন'।ওইদিন দুপুর দু'টো নাগাদ একটা আগুন লাগার খবর আসে। নাবিকরা জাহাজ থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু নিমেষে হাতের বাইরে চলে যায় আগুন। শেষে বিকেল চারটে নাগাদ বোঝা যায় অবস্থা চিকিৎসার বাইরে। নাবিকদের জাহাজ খালি করে পালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু মুহূর্তে এক ভয়াল বিস্ফোরণের আওয়াজে গোটা বন্দর কেঁপে ওঠে! তীব্রতা এতটাই ছিল যে, সিসমোগ্রাফ যন্ত্রেও নাকি সে আওয়াজ ধরা পড়েছিল। আটশোর বেশি মানুষ প্রাণ হারান সেই বিস্ফোরণে। সাত মাস ধরে সেই বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ সাফাই করা হয়েছিল। কিচ্ছু বাঁচেনি। শুধু একটাই ব্যতিক্রম। জাহাজে গোদরেজের সিন্দুক ছিল কিছু। স্রেফ ওইগুলোই বেঁচে যায়। ভেতরের জিনিসপত্র যা ছিল, সেও একরকম অটুট ছিল।

প্রতিষ্ঠাতা আর্দেশির ঘোর স্বদেশী মনোভাবাপন্ন ছিলেন। কোনওদিন ভারতের বাইরে গিয়ে ব্যবসার কথা ভাবতেন না। ভাবতেন দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা, স্বদেশী শিল্পের কথা। ১৯০৬ সালে যখন নরমপন্থী-চরমপন্থীদের মধ্যে তুমুল বিরোধের মাঝে তখন জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসল কলকাতায়। সভাপতিত্ব করলেন প্রবীণ দাদাভাই নওরোজি। শপথ নেওয়া হল স্বরাজের, ডাক দেওয়া হল বিলিতি পণ্য বর্জন ও স্বদেশী পণ্য ব্যবহারের। সেই অধিবেশনেই আর্দেশির প্রস্তাব তুললেন, জৈব, ভেষজ প্রযুক্তিতে সাবান তৈরির কথা। আর্দেশিরের সেই সাবানের পক্ষে প্রস্তাব সমর্থন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অ্যানি বেসান্ত। আজ সেই গোদরেজের 'সিন্থল' সাবান ঘরে ঘরে পরিচিত। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আমলে রমরমিয়ে দেশি ব্যবসা করার প্রভাব পড়েছিল গোদরেজ কোম্পানিতেও। গোদরেজের বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে গিয়ে পদে পদে বাধার মুখে পড়েছেন আর্দেশির। বিলেতের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলে সেই বিজ্ঞাপন ছাপা হতো না। কেন না বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, 'গোদরেজের তালা আমদানি করা তালার মতোই ভাল'।  সেই সময় একমাত্র 'কেশরী', 'ট্রিবিউন'-এর মত দেশী সংবাদপত্রে গোদরেজের বিজ্ঞাপন ছাপা হত। এই অবদান ভোলেননি আর্দেশির। 'কেশরী' সম্পাদক লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলকের স্মৃতিতে তৈরি 'তিলক স্বরাজ ফান্ড'-এ সেই যুগে তিন লক্ষ টাকা দান করেছিলেন তিনি।

 গোদরেজের এক অগ্নিপরীক্ষা ছিল ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে। ১৯৫১ সাল থেকে পাঁচ মাস ধরে চলা ভারতের প্রথম গণতান্ত্রিক পরীক্ষায় দেশের প্রথম বাঙালি নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন নিয়ম করেছিলেন, ব্যালট পেপার নয়, প্রতিটি প্রার্থীর জন্য প্রতিটি বুথে আলাদা ব্যালট বাক্স বানানো হবে। ভারতের জনসংখ্যা ছিল ৩৬ কোটি। তার মধ্যে ১৭ কোটি ছিল বৈধ ভোটার। ৫৩ দলের ১৮৭৪ প্রার্থী দাঁড়িয়েছিলেন সেবার। গোদরেজের দায়িত্ব ছিল সেই ব্যালট বাক্স বানানোর। শুধু স্টিলের বাক্স হলেই হত না। হতে হবে ওয়াটারপ্রুফ, ট্যাম্পার-প্রুফ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ যাতে না হয়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। প্রায় ৭০ রকমের প্রোটোটাইপ তৈরির পরে চূড়ান্ত নকশা অনুমোদন করেন কমিশনার সুকুমারবাবু। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তৈরি হয়েছিল তেরো লক্ষ বাক্স। প্রতিটি বাক্সে ছিল গোদরেজের বিখ্যাত তালা সিস্টেম। সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে সফলভাবে দেশের প্রথম নির্বাচন করে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছিল ভারত।

তালা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে গোদরেজ ফ্রিজ (godrej fridge), আলমারি, সাবানের মতো অন্যান্য আসবাব বানাতে শুরু গোদরেজ। পরে গোদরেজের ব্যবসা বাড়ে স্থাপত্যশিল্পে। তারও ছোঁয়া দেখেছে বোম্বাই। ষাটের দশকে বাণিজ্যনগরী মুম্বইতে পেল্লায় নানা আকাশছোঁয়া অট্টালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। তখন বহু জায়গায় অ্যালুমিনিয়াম ও ইস্পাতের পোক্ত দরজা-জানালার ফ্রেম দিয়েছিল গোদরেজ। আজও টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, এয়ার ইন্ডিয়ার সদর দফতর, ওবেরয় হোটেল-সহ একাধিক নামী ভবনে গোদরেজের ছাপ মারা ফ্রেম দেখা যায়।

গোদরেজ গোটা ভারতের প্রত্যেক পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠে। তবে সম্প্রতি ১২৭ বছরের সুপ্রাচীন এই সংস্থা-পরিবার বিভক্ত হয়ে গেল। পরিবারের মধ্যে বিভক্ত হল এই সংস্থার ফার্ম ও কোম্পানি। আদি গোদরেজ ও তাঁর ভাই নাদির গোদরেজ (Nadir Godrej) এই সংস্থার বিশাল কনগ্লোমারেটের মধ্যে পেয়েছেন গোদরেজ ইন্ডাস্ট্রিজ। গোদরেজ অ্যান্ড বয়স হাতে পেলেন তাঁদের খুড়তুতো ভাই-বোন জামসেদ ও স্মিতা।  এছাড়াও তাঁরা পেয়েছেন মুম্বাইয়ের বিপুল জমি ও ল্যান্ড ব্যাংক। এরোস্পেস থেকে এভিয়েশন, প্রতিরক্ষা, আসবাবপত্র ও আইটি সফটওয়্যার এর অন্তর্গত। গোদরেজের চেয়ারপার্সন ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর হতে চলেছেন জামসেদ গোদরেজ। এগজেকিউটিভ ডিরেক্টর পদ সামলাবেন তাঁর বোন স্মিতার কন্যা নাইরিকা হোলকার। মুম্বইয়ের ৩৪০০ একরের জমিও থাকছে তার মধ্যে। অপরদিকে, নাদির গোদরেজের হাতে থাকবে গোদরেজ ইন্ডাস্ট্রিজ গ্রুপের অধীনে থাকা গোদরেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, গোদরেজ কনজিউমার প্রোডাক্টস, গোদরেজ প্রপার্টিজ, গোদরেজ অ্যাগ্রোভেট ও অ্যাসটেক লাইফসায়েন্স। চেয়ারপার্সন পদ সামলাবেন তিনি। এই ব্যবসাগুলির দেখাশোনা করবেন আদি, নাদির ও তার পরিবারই। গোদরেজ ইন্ডাস্ট্রিজ গ্রুপের এগজেকিউটিভ পদ সামলাবেন পিরোজসা গোদরেজ। ২০২৬ সালের অগস্ট মাস থেকে পিরোজসা দায়িত্ব নেবেন চেয়ারপার্সন পদের।




পিডিএফ ডাউনলোড | Print or Download PDF File